হঠাৎ পা মচকে গেলে করনীয়
পা মচকে যাওয়া, যাকে আমরা গোড়ালি মচকানোও বলে থাকি, একটি অতি সাধারণ আঘাত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হাঁটাচলা করতে গিয়ে, খেলাধুলা করার সময়, অথবা অসতর্কতাবশত পা পিছলে গেলে এই সমস্যা হতে পারে। গোড়ালি মচকানো বলতে মূলত গোড়ালির লিগামেন্টগুলির (যা হাড়ের সাথে হাড়কে যুক্ত রাখে) উপর অতিরিক্ত চাপ পড়া বা ছিঁড়ে যাওয়া বোঝায়। এই আঘাত ছোটখাটো থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, হঠাৎ পা মচকে গেলে কি করা উচিত, তা বিস্তারিতভাবে জানা আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
গোড়ালি মচকানোর কারণ:
- অমসৃণ ভূমিতে হাঁটা: উঁচু-নিচু বা অসমতল রাস্তায় হাঁটলে পা মচকে যেতে পারে।
- খেলার সময় আঘাত: ফুটবল, বাস্কেটবল, টেনিস ইত্যাদি খেলার সময় হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন করলে বা লাফিয়ে পড়লে গোড়ালি মচকাতে পারে।
- পা পিছলে যাওয়া: ভেজা মেঝে, বরফ বা অন্য কোনো পিচ্ছিল জায়গায় পা পিছলে গেলে মচকানোর সম্ভাবনা থাকে।
- উঁচু হিল পরা: উঁচু হিলের জুতো পরলে গোড়ালির উপর বেশি চাপ পড়ে এবং মচকানোর ঝুঁকি বাড়ে।
- আগে মচকানোর ইতিহাস: যাদের আগে একবার গোড়ালি মচকেছে, তাদের আবার মচকানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।

গোড়ালি মচকানোর লক্ষণ:
মচকানোর তীব্রতার উপর নির্ভর করে লক্ষণগুলি বিভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
তীব্র ব্যথা: মচকানোর সাথে সাথেই গোড়ালিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
ফোলা: মচকানো জায়গায় দ্রুত ফোলা শুরু হয়।
কালশিটে পড়া: কয়েকদিনের মধ্যে মচকানো জায়গায় ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে কালশিটে পড়তে পারে।
স্পর্শকাতরতা: মচকানো জায়গা স্পর্শ করলে ব্যথা লাগে।
পা নড়াচড়া করতে অসুবিধা: গোড়ালি নাড়াতে বা পায়ের উপর ভর দিতে অসুবিধা হয়।
ভারসাম্য রাখতে অসুবিধা: হাঁটতে বা দাঁড়াতে অসুবিধা হতে পারে।
মচকানোর তীব্রতা:
গোড়ালি মচকানোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:
(মৃদু): লিগামেন্ট সামান্য প্রসারিত হয় কিন্তু ছিঁড়ে না। অল্প ব্যথা এবং ফোলা থাকে।
(মাঝারি): লিগামেন্টের কিছু অংশ ছিঁড়ে যায়। মাঝারি ব্যথা, ফোলা এবং কালশিটে পড়তে পারে। পা নাড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়।
(গুরুতর): লিগামেন্ট সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায়। তীব্র ব্যথা, ফোলা এবং কালশিটে পড়ে। পা নড়াচড়া করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রাথমিক চিকিৎসা (R.I.C.E. পদ্ধতি):
পা মচকে গেলে প্রথম ২৪-৭২ ঘণ্টা R.I.C.E. নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি ফোলা এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং দ্রুত আরোগ্যের জন্য সহায়ক।
R (Rest/বিশ্রাম): পা মচকালে প্রথমেই পায়ের সম্পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। কোনো রকম নড়াচড়া বা পায়ের উপর ভর দেওয়া উচিত নয়। হাঁটাচলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে ক্রাচ ব্যবহার করতে পারেন।
I (Ice/বরফ): মচকানোর জায়গায় বরফ লাগালে ফোলা এবং ব্যথা কম হয়। একটি কাপড়ে বরফ মুড়ে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পর পর ১৫-২০ মিনিটের জন্য লাগান। সরাসরি ত্বকের উপর বরফ লাগাবেন না, এতে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।
C (Compression/চাপ): ফোলা কমানোর জন্য মচকানো জায়গায় ক্রেপ ব্যান্ডেজ বা ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকা করে বাঁধুন। খেয়াল রাখবেন, বাঁধন যেন খুব বেশি টাইট না হয়, যাতে রক্ত চলাচল বন্ধ না হয়ে যায়। রাতে ঘুমানোর সময় ব্যান্ডেজ খুলে রাখতে পারেন।
E (Elevation/উচ্চতা): পা উঁচু করে রাখলে ফোলা কম হয়। শোয়ার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে পা হার্টের লেভেল থেকে উপরে রাখুন। দিনের বেলাতেও যখন বিশ্রাম নেবেন, পা উঁচু করে রাখুন।
করণীয় এবং বর্জনীয়:
- মচকানোর পর প্রথম ২৪-৪৮ ঘণ্টা পায়ের উপর কোনো চাপ দেবেন না।
- ব্যথা কমানোর জন্য আইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
- মচকানোর জায়গায় গরম সেঁক দেবেন না। গরম সেঁক দিলে ফোলা আরও বাড়তে পারে।
- অতিরিক্ত মালিশ বা নড়াচড়া করবেন না। এতে লিগামেন্টের আরও ক্ষতি হতে পারে।
- ধূমপান পরিহার করুন, কারণ এটি ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নিতে হবে:
*যদি ব্যথা খুব বেশি হয় এবং কোনোভাবেই না কমে।
*যদি পা নাড়াচড়া করতে অসুবিধা হয় বা একেবারেই না নড়ে।
*যদি ফোলা খুব বেশি হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে না কমে।
*যদি ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে কালশিটে পড়ে যায় এবং তা বাড়তে থাকে।
*যদি পায়ের অনুভূতি কমে যায় বা ঝিঁঝিঁ ধরে।
*যদি আঘাতের কয়েক সপ্তাহ পরেও ব্যথা থাকে।
*এইসব ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ অর্থোপেডিক (Orthopedic) বা অস্থি শল্যচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে মচকানোর তীব্রতা নির্ধারণ করে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
শারীরিক চিকিৎসা (Physiotherapy): মচকানোর পর পায়ের শক্তি এবং নড়াচড়া ফিরিয়ে আনার জন্য ফিজিওথেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বিভিন্ন ব্যায়াম এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পায়ের পেশী শক্তিশালী করতে এবং গোড়ালির স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন।
ব্রেস বা সাপোর্ট: গুরুতর ক্ষেত্রে গোড়ালিকে স্থির রাখার জন্য ব্রেস বা সাপোর্ট ব্যবহার করা হতে পারে।
সার্জারি (Surgery): খুব কম ক্ষেত্রেই সার্জারির প্রয়োজন হয়। যদি লিগামেন্ট সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায় বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে কাজ না হয়, তাহলে সার্জারি করা লাগতে পারে।
প্রতিরোধ:
কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে গোড়ালি মচকানোর ঝুঁকি কমানো যায়:
ব্যায়াম করার আগে ওয়ার্ম-আপ: ব্যায়াম শুরু করার আগে সঠিক ওয়ার্ম-আপ করলে পেশী এবং লিগামেন্ট প্রস্তুত হয় এবং আঘাতের ঝুঁকি কমে।
উপযুক্ত জুতো পরিধান: খেলার সময় বা ব্যায়াম করার সময় সঠিক সাপোর্টিভ জুতো পরা উচিত। উঁচু হিলের জুতো পরিহার করা উচিত।
পায়ের পেশী শক্তিশালী করার ব্যায়াম: নিয়মিত পায়ের পেশী শক্তিশালী করার ব্যায়াম করলে গোড়ালির স্থিতিশীলতা বাড়ে এবং মচকানোর ঝুঁকি কমে।
সতর্কভাবে হাঁটাচলা: উঁচু-নিচু বা পিচ্ছিল জায়গায় সাবধানে হাঁটা উচিত।
শারীরিক অবস্থা ঠিক রাখা: অতিরিক্ত ওজন বহন করলে গোড়ালির উপর বেশি চাপ পড়ে। তাই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
পা মচকে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, উপরে দেওয়া নিয়মগুলি মেনে চললে আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং জটিলতা এড়াতে পারবেন। যেকোনো গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজের শরীরের যত্ন নিন এবং সুস্থ থাকুন। Healthx BD
আরও জানুন –
প্রায়ই হাত-পায়ে ব্যথা হচ্ছে, কীভাবে বুঝবেন বড় কোনো রোগের লক্ষণ
শিশুর উচ্চতা বাড়ছেনা ? সন্তানকে যা খাওয়াবেন
বোন টিবি বা হাড়ে যক্ষ্মা হলে বুঝবেন কীভাবে