কব্জির ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা, যা হঠাৎ ইনজুরির ফলে হতে পারে। মচকে যাওয়ার কারণে কিংবা হাড় ভেঙে কব্জিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্যও কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, যেমন বারবার চাপ পড়া, বাত, অথবা কারপাল টানেল সিনড্রোম। যেহেতু কব্জির ব্যথার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, তাই কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা কঠিন হয়। সঠিক রোগ নির্ণয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আপনার কব্জির ব্যথার সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণে সহায়তা করে।
কব্জির ব্যথার উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা নির্ভর করে ব্যথার কারণের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ব্যথা সাধারণত ভোঁতা ধরনের, ঠিক যেমন দাঁতের ব্যথা। অন্যদিকে, টেনডনের প্রদাহ বা টেনডিনাইটিসের ব্যথা সাধারণত তীক্ষ্ণ ও ধারালো অনুভূতির হয়।
কব্জির ব্যথার কারণ
কব্জি, বা রিস্ট জয়েন্ট, একটি জটিল সন্ধি যা কয়েকটি হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত—যেমন রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আটটি ছোট কারপাল হাড়। এই কারপাল হাড়গুলো দুই সারিতে সাজানো। লিগামেন্টের শক্ত ব্যান্ড কব্জির হাড়গুলোকে একে অপরের সাথে এবং রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশকে হাতের হাড়গুলোর সাথে সংযুক্ত করে। টেনডনগুলো হাড়ের সাথে মাংসপেশিকে যুক্ত করে। কব্জির যেকোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে এবং এটি হাত ও কব্জির কার্যক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।
কব্জি ব্যথার সাধারণ কারণগুলো এখানে বর্ণিত হলো :
১. ইনজুরি
হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলে কব্জিতে গুরুতর ইনজুরি হতে পারে। এর ফলে কব্জি মচকে যেতে পারে, টান পড়তে পারে এবং কখনও হাড় ভেঙেও যেতে পারে। কব্জির বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে থাকা হাড়টির নাম স্কাফয়েড, যা অনেক সময় ভেঙে যায়। এই ধরনের হাড় ভাঙলে তা তৎক্ষণাৎ এক্স-রেতে ধরা নাও পড়তে পারে। ব্যথা দীর্ঘদিন থাকে, কব্জি নড়াচড়া করলে ব্যথা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রেই হাত দিয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্লাস্টার করেও ব্যথা কমানো সম্ভব নাও হতে পারে, তাই অপারেশন করতে হতে পারে। স্কাফয়েড ভেঙে গেলে হাড়ের মধ্যে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়, যা হাড়ের জোড়া লাগতে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং এ কারণে ব্যথা হয় ও কব্জি নড়াতে অসুবিধা হয়, তখন অপারেশন প্রয়োজন হয়। হাতের ওপর ভর দিয়ে পড়ে গেলে সাধারণত কলিস ফ্রাকচার ঘটে, যার ফলে রেডিয়াসের নিচের অংশ ভেঙে যায় এবং কব্জি ফুলে যায়।
যেকোনো কাজ, যেমন টেনিস বল খেলা বা বেহালা বহন করার সময় কব্জি বারবার নড়াতে হলে কব্জির টিস্যুতে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে অথবা হাড় ভেঙে যেতে পারে, বিশেষ করে বিরতি ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করলে। বারবার চাপের কারণে হাতের কব্জির ব্যথার আরেকটি কারণ হলো ডি কোয়ারভেইন ডিজিজ। এ ক্ষেত্রে ব্যথা সাধারণত বৃদ্ধাঙ্গুলির মূলে অনুভূত হয়। ডি কোয়ারভেইন ডিজিজে কব্জি নড়াতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, কাজ করতে অসুবিধা দেখা দেয় এবং কাজের পর ব্যথা বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধাঙ্গুলে চাপ দিলে অত্যন্ত তীব্র ব্যথা হয়।
২. আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা
অস্টিও আর্থ্রাইটিস : সাধারণত কব্জিতে অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ঘটনা খুবই কম ঘটে। তবে যদি আগে কব্জিতে ইনজুরি হয়ে থাকে, তখন পরবর্তীতে অস্টিও আর্থ্রাইটিস দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ক্ষতিগ্রস্ত বা ছিঁড়ে যায়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি একটি এমন অবস্থা, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। কব্জিতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ঘটনা সাধারণত বেশি দেখা যায়। যদি একটি কব্জি আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণত অন্য কব্জিতেও এটি দেখা দেয়।
৩. অন্যান্য রোগ ও অবস্থা
কারপাল টানেল সিনড্রোম:কব্জির তালুর দিকের একটি পথ রয়েছে, যাকে কারপাল টানেল বলা হয়; এর মধ্য দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ প্রবাহিত হয়। যখন মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়ে, তখন কব্জি ও হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ অবস্থাকে কারপাল টানেল সিনড্রোম বলা হয়।
গ্যাংলিয়ন সিস্ট:কব্জির ব্যথার অন্যতম কারণ হলো গ্যাংলিয়ন, যা একটি টিউমার জাতীয় ফোলা। এটি সাধারণত টেনডনের আবরণ থেকে কব্জির পিছনে বা সামনের দিকে ওঠে। কব্জি নড়াচড়া করলে ব্যথা হয়। বড় গ্যাংলিয়ন সিস্টের তুলনায় ছোটগুলো বেশি ব্যথা সৃষ্টি করে।
কিয়েন বক্স ডিজিজ: এটি সাধারণত তরুণদের মধ্যে দেখা যায়। এই অবস্থায় কব্জির লুনেট নামের ছোট হাড়টির রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে হাড়টি কোলাপস করে। লুনেট হাড়ের ওপর চাপ দিলে ব্যথা হয় এবং রোগী হাত মুঠো করে ধরতে পারে না।
কব্জি ব্যথার ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো:
কোনো ব্যক্তি হালকা বা ভারী কাজ করলেও কব্জিতে ব্যথা অনুভব করতে পারে। তবে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ব্যথা বাড়াতে পারে, যেমন:
- খেলাধুলা:বিভিন্ন খেলাধুলায়, যেমন বোলিং, গলফ, জিমন্যাস্টিক এবং টেনিস, কব্জিতে ইনজুরি হতে পারে।
- বারবার কাজ করা: হাত ও কব্জির যেকোনো কাজ পুনরাবৃত্তি করলে কব্জির ব্যথা বাড়তে পারে। বিশেষ করে যারা হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ার কাজ করেন, বুননের কাজ করেন, বা চুল কাটেন, তাদের কব্জির ব্যথা বেশি হয়। কম্পিউটার কিবোর্ডে টাইপ, মাউস ব্যবহার, সেলাই, আঁকাআঁকি, লেখালেখি অথবা ভাইব্রেটিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেও এই সমস্যা বাড়তে পারে। ডায়াবেটিস, লিউকেমিয়া, স্ক্লেরোডার্মা, লুপাস অথবা থাইরয়েড সমস্যা থাকলে কব্জির ব্যথা বাড়তে পারে।
প্রাথমিকভাবে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করা উচিত, যারা পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করতে পারেন, যেমন রিউমাটোলজিস্ট, স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা অর্থোপেডিক সার্জন। বিশেষজ্ঞকে উপসর্গের বিস্তারিত বর্ণনা, পূর্ববর্তী রোগের ইতিহাস, এবং খাদ্যাভ্যাস জানানো জরুরি।
চিকিৎসা:
হাতের কব্জির ব্যথার চিকিৎসা ইনজুরির গঠন, স্থান, তীব্রতা, বয়স ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, আক্রান্ত কব্জিকে বিশ্রামে রাখতে হবে, এবং যদি কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে ব্যথা হয়, তাহলে তার যথাযথ চিকিৎসা করতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ, যেমন আইবুপ্রফেন ও অ্যাসিটামিনোফেন, কব্জির ব্যথা কমাতে সহায়ক। প্রয়োজনে শক্তিশালী ব্যথানাশকও দেওয়া হতে পারে।
হাড় ভাঙলে সঠিকভাবে জোড়া লাগানোর জন্য কাস্ট বা স্প্লিন্ট ব্যবহার করা হয়। কব্জিতে টান লাগলে বা মচকে গেলে স্প্লিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে টেনডন বা লিগামেন্ট সুরক্ষিত থাকে। আক্রান্ত কব্জিকে নড়াচড়া থেকে রক্ষা করতে রিস্টব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে, যেমন মারাত্মকভাবে হাড় ভাঙলে, কারপাল টানেল সিনড্রোমের তীব্র উপসর্গ থাকলে বা টেনডন বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে।Healthx BD
আরও জানুন-
–শরীরের ইমিউনিটি বাড়ুক ন্যাচারালি