ওজন কমানোর জন্য অনেক পরিশ্রম এবং নানা কৌশল প্রয়োজন। বিভিন্ন পরামর্শ ও নির্দেশাবলী শুনতে হয়, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্যভ্যাস ঠিক রাখা। কঠোর ডায়েটের চেয়ে ভালো, সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
ওজন কমাতে কিছু নির্দেশনা-
১. সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন-
সঠিকভাবে ওজন কমানোর প্রথম পদক্ষেপ হল সুষম খাদ্যাভ্যাস পালন করা। খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রোটিন, শাকসবজি, ফলমূল এবং হোল গ্রেইন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। প্রোটিন ওজন কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ক্ষুধা কমায় এবং দীর্ঘ সময় পেট পূর্ণ রাখে। প্রোটিনের ভালো উৎস হিসেবে মুরগির মাংস, ডিম, মাছ, ডাল, ছোলা ইত্যাদি উপকারী।
২. নিয়মিত ব্যায়াম করুন-
শারীরিক ব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য অপরিহার্য। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন। এর মধ্যে হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, যোগব্যায়াম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ব্যায়াম শুধু ওজন কমায় না, এটি শরীরের মেটাবলিজম বাড়ায়।
৩. পানি পান করুন-
ওজন কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয় এবং মেটাবলিজম বাড়ায়। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন। খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে পানি পান করলে ক্ষুধা কমে যায় এবং অতিরিক্ত খাবার খাওয়া এড়ানো যায়।
৪. নিয়মিত ঘুম-
সুস্থ শরীরের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো নিশ্চিত করুন। ঘুমের অভাব মেটাবলিজম কমিয়ে দেয় এবং ক্ষুধা বাড়ানোর হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করতে পারে।
৫. চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় পরিহার করুন-
চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় ওজন বাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ। কোমল পানীয়, মিষ্টি, ক্যান্ডি ইত্যাদি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলি উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত এবং শরীরের চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ায়।
৬. হোল গ্রেইন খাবার খান-
হোল গ্রেইন যেমন ব্রাউন রাইস, ওটমিল, এবং সম্পূর্ণ গমের রুটি ওজন কমাতে সহায়ক। এগুলিতে ফাইবার থাকে যা হজম প্রক্রিয়া ধীর করে এবং পেট দীর্ঘ সময় ভরাট রাখে।
৭. অল্প খাবার খান কিন্তু বার বার খান –
বড় খাবারের চেয়ে অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়া ওজন কমাতে বেশি কার্যকর। দিনে ৫-৬ বার খাবার খান যাতে প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার থাকে। এটি মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়।
৮. সবুজ চা পান করুন-
সবুজ চায়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা মেটাবলিজম বাড়াতে এবং ফ্যাট বার্ন করতে সহায়ক। প্রতিদিন ২-৩ কাপ সবুজ চা পান করার চেষ্টা করুন।
৯. পর্যাপ্ত শাকসবজি ও ফলমূল খান-
শাকসবজি ও ফলমূল ওজন কমাতে খুবই সহায়ক। এগুলিতে ফাইবার এবং ভিটামিন-এ, সি, এবং কে থাকে যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। এগুলি খেলে পেট ভরা থাকে এবং অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণের প্রবণতা কমে।
১০. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট-
স্ট্রেস ওজন বাড়ানোর একটি কারণ হতে পারে। স্ট্রেস কমাতে ধ্যান, যোগব্যায়াম, এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন। এগুলি মানসিক শান্তি দেয় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
১১. খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন-
খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা ওজন কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। খাবার খাওয়ার সময় ছোট প্লেট ব্যবহার করুন যা খাবারের পরিমাণ কম রাখতে সাহায্য করবে। এছাড়া, মনোযোগ দিয়ে খাবার খেলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া কমে যায় এবং খাবারের স্বাদ ভালোভাবে উপভোগ করা যায়।
১২. চিনিযুক্ত পানীয় পরিবর্তে প্রাকৃতিক পানীয় পান করুন –
চিনিযুক্ত পানীয় এবং কোমল পানীয় পরিহার করে প্রাকৃতিক পানীয় যেমন লেবু পানি, নারকেলের পানি, এবং তাজা ফলের রস পান করুন। এগুলি কম ক্যালোরি যুক্ত এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
১৩. সক্রিয় থাকুন-
দৈনন্দিন জীবনে বাড়িতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন। লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, কাছাকাছি স্থানে হাঁটুন, এবং বসার সময় ঘন ঘন উঠে হাঁটুন। বাড়তি সক্রিয়তা মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
১৪. সঠিক পরিমাণে প্রোটিন খান-
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ওজন কমাতে সহায়ক। এটি ক্ষুধা কমায় এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে। ডিম, মুরগি, মাছ, এবং ডাল প্রোটিনের ভালো উৎস।
১৫. স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়া –
স্ন্যাকস খাওয়ার সময় স্বাস্থ্যকর বিকল্প যেমন বাদাম, ফল, এবং দই বেছে নিন। এগুলি কম ক্যালোরি যুক্ত এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ।
ওজন কমানোর সুবিধা
১. হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো-
ওজন কমালে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো সমস্যাগুলির জন্ম দিতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ওজন কমানোর ফলে এসব সমস্যা কমে আসে এবং হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকে।
২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ-
ওজন কমিয়ে টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। শরীরের ওজন কমলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা উন্নত হয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক।
৩. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ-
ওজন কমানো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ওজন কমালে রক্তনালীতে চাপ কমে এবং রক্ত সঞ্চালন সহজ হয়, ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কমে যায়।
৪. হাড় ও জয়েন্টের সুরক্ষা –
অতিরিক্ত ওজন হাড় ও জয়েন্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য জয়েন্টের সমস্যার কারণ হতে পারে। ওজন কমালে এই চাপ কমে যায় এবং হাড় ও জয়েন্ট সুস্থ থাকে।
৫. শ্বাসকষ্ট ও ঘুমের মান উন্নতি –
ওজন কমানোর ফলে শ্বাসকষ্ট কমে এবং ঘুমের মান উন্নত হয়। অতিরিক্ত ওজন ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা ওজন কমালে কমে যায়।
৬. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি-
ওজন কমালে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। অতিরিক্ত ওজন কমালে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং মানসিক চাপ কমে যায়। এর ফলে নিজেকে ভালোভাবে অনুভব করা ও দেখতে পাওয়া যায়।
৭. শক্তি ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি –
ওজন কমালে শরীরে শক্তি ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ওজন কমলে শরীর হালকা হয় এবং কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ওজন কমানো একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া যা সময় এবং ধৈর্যের প্রয়োজন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চললে আপনি সফলভাবে ওজন কমাতে পারবেন। নিজেকে সময় দিন, লক্ষ্য স্থির রাখুন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনুন এবং নিজের প্রতি সদয় থাকুন। Healthx BD
আরও জানুন-