মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের চারপাশে থাকা সূক্ষ্ম টিস্যু স্তরকে মেনিনজেস বলা হয়। এই টিস্যু স্তরের সংক্রমণের ফলে যে প্রদাহ ঘটে, তাকে মেনিনজাইটিস বলা হয়। মেনিনজাইটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলি দেখে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা কঠিন হতে পারে। যদিও শনাক্ত করা সম্ভব হলেও, প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া, ২০ শতাংশ রোগী বেঁচে গেলেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়।
অসংক্রামক মেনিনজাইটিসও দেখা যেতে পারে। এই ধরনের মেনিনজাইটিসের কারণগুলোর মধ্যে ক্যান্সার, সিস্টেমেটিক লুপাস এরিথিমেটোসাস (লুপাস), কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, মাথায় আঘাত বা অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত। পাঁচ বছরের নিচের শিশু এবং ১৫-১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
মেনিনজাইটিসের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণেই সাধারণত মেনিনজাইটিস হওয়ার ঘটনা বেশি দেখা যায়। মাথার বিভিন্ন অংশ, যেমন নাক, কান, বা গলা, যা মস্তিষ্কের কাছাকাছি সংক্রমিত হয়, তা ভেতরে ছড়িয়ে গিয়ে মেনিনজাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, মাথায় আঘাত লাগলে মস্তিষ্কে জীবাণু প্রবাহ মুক্ত হয়ে মেনিনজাইটিস হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, শরীরের অন্য অংশে থাকা সংক্রমণও মেনিনজাইটিসের কারণ হতে পারে।
কারণ ও প্রকারভেদ
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস– বয়সভেদে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী। সদ্যোজাত ও তিন মাস বয়সী শিশুর মধ্যে প্রধানত গ্রুপ-বি স্ট্রেপটোকোক্কাস এবং লিস্টেরিয়া দায়ী থাকে। সাধারণত লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনেসিস দ্বারা মেনিনজাইটিস হয়ে থাকে। পরিণত শিশুদের ক্ষেত্রে নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস, স্ট্রেপটোকোক্কাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি মেনিনজাইটিসের কারণ হয়ে থাকে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনেসিসের কারণে মেনিনজাইটিসের প্রকোপ অনেক বেশি দেখা যায়।
ভাইরাল মেনিনজাইটিস- ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রধান কারণ হলো এন্টেরোভাইরাস। এছাড়া, কিছু অন্যান্য ভাইরাসও এই রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা মশার মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে যেতে পারে।
ছত্রাক জনিত মেনিনজাইটিস- ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিসের মূল কারণী জীবাণু হচ্ছে ক্রিপটোকক্কাস নিউফরম্যান্স। যেসব রোগীরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ওষুধ ব্যবহার করেন, এইডস/এইচআইভি আক্রান্ত, বা বয়স্ক ব্যক্তি, তারা ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিসের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিসের প্রভাব আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বেশি, এবং এটি ২০-২৫ শতাংশ এইডস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য ফাঙ্গাস যা মেনিনজাইটিসের সৃষ্টি করতে পারে সেগুলোর মধ্যে হিস্টোপ্লাজমা ক্যাপসুলাটাম, কক্কিডায়োআইডেস ইমিটিস, ব্লাস্টোমাইসেস ডার্মাটাইটিস, এবং ক্যানডিডা স্পেসিস উল্লেখযোগ্য।
পরজীবীঘটিত মেনিনজাইটিস- এ ধরনের মেনিনজাইটিসের প্রধান প্রধান প্যাথোজেনের মধ্যে রয়েছে অ্যাংজিওস্ট্রংগাইলাস, ক্যান্টোনেনসিস, গ্যান্থোসটোমা স্পিনিজেরাম, এবং সিস্টোসোমা। প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিসে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে ইসোনোফিল (এক প্রকার শ্বেত কণিকা) উপস্থিত থাকে।
জীবাণুবিহীন মেনিনজাইটিস- মেনিনজাইটিস কেবল জীবাণুর কারণে নয়, অন্যান্য কিছু কারণে হতে পারে। এর মধ্যে ক্যান্সারের বিস্তার, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ (যেমন ব্যথা ও প্রদাহরোধী ওষুধ, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, জীবাণুবিরোধী ওষুধ), সারকোডিয়াসিস, কানেকটিভ টিস্যু ডিজঅর্ডার, এবং সিস্টেমিক লুপাস ইরিথেমেটাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিছু ক্ষেত্রে মাইগ্রেনও মেনিনজাইটিসের কারণ হতে পারে, যদিও এটি কম ঘটে। মেনিনজেস, যা তিনটি স্তর (ডুরামাটার, আর্কনয়েডমাটার, এবং পিয়ামাটার) দিয়ে গঠিত, মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডকে আবরণ ও সুরক্ষা প্রদান করে। ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে, ব্যাকটেরিয়া রক্ত প্রবাহ বা নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে মেনিনজেসের সাথে যোগাযোগ করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। নবজাতকের রক্তে গ্রুপ-বি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে, মেনিনজাইটিসের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ হতে পারে।
লক্ষণ-
মেনিনজাইটিসের প্রধান লক্ষণ হলো মাথাব্যথা। এতে সাধারণত তীব্র জ্বর, ঘাড়ের কঠোরতা, শরীরে লাল দাগ ও অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে সব ক্ষেত্রে একই লক্ষণ একইভাবে প্রকাশ পায় না। এছাড়া, মেনিনজাইটিস মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। ভাইরাসজনিত মেনিনজাইটিসে তীব্র মাথাব্যথা এবং জ্বর থাকে, যা অত্যন্ত অস্বস্তিকর হলেও সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া বা যক্ষ্মার জীবাণুর কারণে মেনিনজাইটিস হলে গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এবং এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে মস্তিষ্কের চারপাশে থাকা সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের (সিএসএফ) স্বাভাবিক প্রবাহ বাধিত হতে পারে, মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হতে পারে, এবং মস্তিষ্ক ফুলে উঠতে পারে। যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট মেনিনজাইটিস সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণ হয় এবং চিকিৎসা না হলে এটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক হতে পারে।
যেভাবে ছড়ায়-
মেনিনজাইটিস সাধারণত দ্রুত সংক্রমিত হয় না, কিন্তু ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস নাক ও গলার নিঃসরণ দ্বারা সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়াতে পারে। একজন সুস্থ ব্যক্তি কোনো উপসর্গ ছাড়াই মেনিনজাইটিসের জীবাণু বহন করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত গ্লাস, থালাবাসন বা সিগারেট ভাগাভাগি করার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এছাড়া, ভাইরাল মেনিনজাইটিস মলের মাধ্যমেও একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারে।
করণীয়-
মেনিনজাইটিসের প্রতিরোধের জন্য নাক, কান, গলা, এবং মুখের সংক্রমণ এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। কভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে যা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়, তা মেনিনজাইটিস প্রতিরোধেও সহায়ক হতে পারে। মাথায় আঘাত লাগলে দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে। মাথাব্যথা হলেই মেনিনজাইটিস হতে পারে না; তবে যদি মাথাব্যথার সাথে জ্বর ও ঘাড়ের কঠোরতা দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। Healthx BD
–পিসিওএস প্রতিরোধে সঠিক সচেতনতা