শরীরে যে কোনও কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বলা হয় টিউমার। ব্রেন টিউমার হল মস্তিষ্কের কোনও কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই টিউমার শুধু মস্তিষ্কেও হতে পারে আবার শরীরের অন্য অংশে তৈরি হয়ে মস্তিষ্কে ছড়াতে পারে।
ব্রেন টিউমারের কয়েকটি ধরন আছে। ব্রেন টিউমার সাধারণত দুই ধরনের হয়।
১.ক্যান্সারযুক্ত অর্থাৎ ম্যালিগন্যান্ট
২.ক্যান্সারহীন বা বিনাইন
ব্রেন টিউমারের লক্ষণ: টিউমারটি কোথায় হয়েছে, স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর নির্ভর করে দেখা দেয় উপসর্গ। তাই সামান্য কিছু লক্ষণ দেখলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এজন্য জেনে রাখা ভালো ব্রেন টিউমারের উপসর্গ কী কী। যদিও ব্রেন টিউমারের লক্ষণ কেমন হবে বিষয়টি রোগীভেদে বদলে যায়।সাধারণ কিছু উপসর্গগুলো হলো:
- ব্রেন টিউমারের প্রাথমিক লক্ষণ মাথাব্যথা ও চোখে ঝাপসা দেখা। তবে মাথাব্যথা মানেই ব্রেন টিউমার নয়। সাধারণত মাথাব্যথার ১ শতাংশেরও কম কারণ হলো ব্রেন টিউমার।
- ব্রেন টিউমারের জন্য যে মাথাব্যথা হয়, তা সাধারণত খুব ভোরে শুরু হয়। সঙ্গে খিঁচুনি হতে পারে। খিঁচুনি সাধারণত হাতে বা পায়ে বা অন্য কোনো স্থান থেকে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই মাথাব্যথা কিছুতেই যেতে চায় না।
- মস্তিষ্কের ভেতর পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে টিউমার হলে রোগীর দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। রোগী সামনের অংশটুকু ভালো দেখতে পেলেও দুপাশে দেখতে পান না এবং একপর্যায়ে অন্ধ হয়ে যান।
- ব্রেনের সামনের অংশে বা ফ্রন্টাল লোবে টিউমার হলে রোগীর স্মৃতিশক্তি কমে যায়। তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেন। দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
- মটর এরিয়ায় টিউমার হলে যেদিকে টিউমার তার উল্টো দিকে প্যারালাইসিস হয়ে থাকে।
- মস্তিষ্কের খুলির নিচের প্রকোষ্ঠে টিউমার হলে রোগী হাঁটতে গেলে পড়ে যান বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কানে ঠিকমতো শোনেন না। কথা স্পষ্ট করে বলতে পারেন না।
- টিউমার বেশি বড় হয়ে গেলে রোগীর হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে।
ব্রেন টিউমার নির্ণয়: ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে যথাসম্ভব দ্রুত নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগ নির্ণয়ে নিচের পরীক্ষাগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে।যেমন:
- ব্রেনের সিটিস্ক্যান ও এমআরআই
- স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখার জন্য ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি বা ইইজি
- স্নায়ুতন্ত্রের পরিবহন ক্ষমতা বা নার্ভ কন্ডাকশন টেস্ট বা ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি
- সিটি গাইডেড এফএনএসি
- তবে এমআরআই পদ্ধতি সব থেকে আধুনিক এবং ব্রেন টিউমার নির্ণয়ের জন্য উন্নত পরীক্ষা।
ব্রেন টিউমারের কারন: ব্রেইন টিউমার হওয়ার কারণ এখনো অজানা । তবে দেখা গেছে,
- কিছু ছোট টিউমার আছে যা জীনগত ত্রুটির ফলে হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কোন পরিবারে এ ধরনের জীনগত ত্রুটি থাকলে একই পরিবারের মধ্যে অনেকের ব্রেইন টিউমার হতে পারে ।
- মানবশরীরে কিছু জিন আছে, যা টিউমার হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে। এদের বলে টিউমার সাপ্রেসর জিন। কোনো কারণে টিউমার সাপ্রেসর জিন যদি যথাযথ কাজ না করে, তাহলে ব্রেন টিউমার হয়ে থাকে।
চিকিৎসা: যখন মাথায় এই টিউমার বৃদ্ধি পায় তখন মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বেড়ে যায় যা মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সঠিক সময়ে ব্রেন টিউমার চিকিৎসা প্রয়োজন। কত দ্রুত টিউমারটি বেড়ে উঠছে, কোন অংশে হয়েছে, স্নায়ু কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, টিউমারটি ক্যানসারাস কি না ইত্যাদি বিষয় দেখার পরই চিকিৎসকরা রোগীর চিকিৎসা করেন।
- সাধারণত ব্রেন টিউমার হলে অপারেশনের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই সিদ্ধান্ত একান্তই চিকিৎসকের। টিউমারের আকার, অবস্থান, সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য শারীরিক অবস্থা বিচার করে তবেই অপারেশনের দিকে এগোন চিকিৎসকেরা।
- সব সময় যে সার্জারির প্রয়োজন হয় এমনও নয়।
- কাজ হয় ওষুধেও।
- আবার অপারেশনের পর অনেকের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি থাকে। সব কিছুই নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপরে।
ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি কাদের বেশি:
- বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে ষাটোর্ধ্ব বা তারও বেশি বয়সে মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
- ব্রেন এক্স রে, সিটি স্ক্যান, রেডিওথেরাপি বেশি মাত্রায় হলেও এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
- জিনগত রোগ যেমন- স্কেলেরোসিস, টার্নার সিনড্রোম, টাইপ ১ ও টাইপ ২ নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস আছে এমন ব্যক্তিদের।
- পরিবারে এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে।
- পুরুষরা নারীদের চেয়ে এ রোগে বেশি ভোগেন।
- মাথায় আঘাত পান যারা।
যেভাবে ব্রেন টিউমারের হাত থেকে নিরাপদ থাকা যাবে:
ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সঠিক কারণ এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু সাধারণ নিয়ম ও স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা ব্রেন টিউমারকে দূরে রাখতে কাজ করবে বলে বিশ্বাস করে বিশেষজ্ঞরা। যার মাঝে রয়েছে –
ক্যানসার প্রতিরোধী খাবার গ্রহণ: প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান থেকে ক্যানসার বিরোধী উপাদান পাওয়া যায়। আপেল, আঙ্গুর, ব্রকলি, গাজরের মতো উপকারী এই সকল খাদ্য উপাদানগুলোকে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম: চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে।
মোবাইলের সীমিত ব্যবহার: মোবাইল ফোন থেকে নিঃসৃত রশ্মি ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সম্ভবনাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই মোবাইল ফোন যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে।
ধূমপান বর্জন করা: সন্দেহাতীতভাবে এই বিষয়ে একমত পোষণ করতেই হবে যে ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এছাড়া ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে এই বদ অভ্যাসটি।
এছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা করা, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি মূলক কাজ করা (ধাঁধা কিংবা গণিত সমাধান), মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, উপোরক্ত লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি বিকাশের ফলে উন্নত পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই মস্তিষ্কের টিউমার নির্ণয় করা যায়। সম্পূর্ণ ও সঠিক চিকিৎসায় অনেক রোগীই সুস্থ হয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে
৮ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ব্রেন টিউমার দিবস। ১৯৯৮ সালে জার্মান ব্রেন টিউমার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি দাতব্য সংস্থা গঠিত হয়। ২০০০ সাল থেকে এই সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ব্রেন টিউমার দিবস। মানুষের মধ্যে ব্রেন টিউমার সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়াতেই এ দিবষটি পালন করা হয়।