প্রকৃতিতে ছয় ঋতুর মধ্যে শীতকালের বৈশিষ্ট্য যেন এক অনন্য মাত্রা এনে দেয় মানুষের জীবনে। শীতের বাতাস আর কুয়াশায় ঢাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রকৃতিকে যেমন সতেজ করে তোলে তেমনি শীত এলেই বাড়ে অসুখ-বিসুখ।শীতকালের শুষ্ক আবহাওয়ায় সর্দি-কাশি-জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন অনেকে। বাচ্চাদের জন্য এ সময়টা তো বিশেষ সমস্যারই। এ সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।শীতের সময় ফ্লু, ঠান্ডাজ্বর, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ শরীরকে সহজেই করে ফেলতে পারে কাবু। তাই শীতে সুস্থ থাকতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন ঠিক তাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখা জরুরি।শীতে কিছু খাবার আপনাকে সজীবতা ও সুস্থতা দেবে। অসুস্থতার হাত থেকে বাঁচতে এ সময় কোন কোন খাবারগুলো খাবেন চলুন জেনে নেয়া যাক।
পানি
শীতকালে ঠান্ডার কারণে আমাদের শরীরের পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। জলবায়ু রুক্ষ ও শুষ্ক হওয়ায় আমাদের ত্বক ফাটতে থাকে।তাই শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে বেশি পানি পান করা জরুরি।
মসলা চা
পানীয় হিসেবে পান করুন মসলা চা। আদা, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ এসব মসলা দিয়ে চা বানিয়েও পান করতে পারেন।
দুধ
ভিটামিন বি৬-এর অন্যতম ভালো উৎস হলো দুধ।রাতে ঘুমানোর আগে গরম দুধ পান করতে পারেন। দুধ আপনার প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে ও শরীরে শুক্ত যোগাবে।
ভিটামিন সি
ভিটামিন-সি শরীরের রোগদমন তন্ত্রকে সাহায্য করে থাকে। প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ৭৫ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ৯০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি গ্রহণ করা উচিত। শরীরে ভিটামিন ‘সি’ এর চাহিদা পূরণ করতে ‘সাইট্রাস’ জাতীয় ফলের জুড়ি মেলা ভার। পাতিলেবু, মোসম্বি ও কমলা যেমন জোগান দিতে পারে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি-এর, তেমনই মেটাতে পারে ফাইবারের ঘাটতি। পেয়ারাতেও থাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম।
সিদ্ধ ডিম
শীতে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করতে ও তাজা রাখতে সিদ্ধ ডিমের ভূমিকা অনন্য। ডিম পুরো বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি খাবার। এটিতে রয়েছে অনেক বিস্ময়কর উপাদান, যা শরীরের জন্য অনেক উপকারি এইজন্যই এটি খুব জনপ্রিয়। ডিমের মধ্যে রয়েছে ৯টি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড। ডিমে রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন, যেমন—বি২, বি১২, এ ও ই; রয়েছে জিংক, ফসফরাস এবং প্রয়োজনীয় মিনারেল। শীতের খাবার হিসেবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় তাই ডিম রাখতে পারেন। তবে উপযুক্ত উপকার পেতে অবশ্যই আপনাকে সিদ্ধ করে নিয়মিত সকালে খেতে হবে।
ফাইবার যুক্ত খাবার
বেশি পরিমাণে ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে। আপেল, ওটস এবং বাদাম ফাইবার যুক্ত খাবার। এগুলো শরীরের ওজন এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে। ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। বয়স্কদের জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মধু-গুড়
শীতে চিনির বিকল্প হিসেবে মধু বা গুড় ব্যবহার করাই ভালো। এ সময় নিয়মিত খেতে পারেন মধু। সকালে গরম পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন। অথবা অন্য খাবার বা সালাদের ড্রেসিংয়েও মধু যোগ করতে পারেন। মধুতে প্রচুর পুষ্টিগুণ আছে। এছাড়া এটি আমাদের শরীর অনেকক্ষণ গরম রাখে।গুড়ে প্রচুর পরিমাণ আয়রন পাওয়া যায়। এ কারণে গুড় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
পালং
শীতে বাজারে পালং শাক প্রচুর পাবেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও শীতে সুস্থ থাকতে পালং শাক খেতে পারেন। পুষ্টিতে ভরপুর পালংয়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ক্যানসারপ্রতিরোধী গুণের কারণে এটি ‘সুপারফুড’ হিসেবে পরিচিত। সবুজ পাতার এ শাক দ্রুত পেটের চর্বি কমাতে পারে। পালংয়ে ভিটামিন ও মিনারেল আছে, এতে ক্যালরি থাকে কম। তাই ওজন কমাতে খাবারে বেশি করে পালং রাখতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের ওজন বেশি, তাঁরা নিয়মিত পালং শাক খেলে বাড়তি ওজন কমে যায়।
স্যুপ
স্যুপ শীতে শরীর সুস্থ রাখতে স্যুপ বা ঝোল দারুণ উপকারী। শীতেই মেলে স্যুপের আসল মজা। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম-গরম স্যুপ। শীতের বিকেলে বা রাতের খাবারে ধোঁয়া ওঠা এক বাটি স্যুপ হলে মন্দ হয় না। এতে শরীর থেকে একটু হলেও কাটবে ঠান্ডার রেশ। শরীর সুস্থ রাখতে শীতের সময় নানা সবজি আর মুরগির মাংস বা ডিম দিয়ে বানিয়ে খেতে পারেন স্যুপ।
ঘি
ঘি দিয়ে তৈরি খাবার খেতে পারেন। রান্নার তেলের বদলে ঘি ব্যবহার করতে পারেন। ঘিয়ে যে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে তা শরীর গরম রাখে প্রাকৃতিকভাবে। ঘি আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতেও একটি উপকারী খাবার।
মূলজাতীয় সবজি
বিট, গাজর, প্রভৃতি শীতকালীন সবজি ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করতে ও খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে অত্যন্ত উপযোগী। তাই শীতকালে সুস্থতার চাবিকাঠি হতেই পারে এই সবজিগুলো।
লাল ক্যাপসিকাম
শরীরেরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য খুবই উপকারী একটি খাবার হলো, লাল ক্যাপসিকাম। কারণ এতে ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-সি এর পাশাপাশি বিটা ক্যারোটিনও আছে। ভিটামিন-সি সুস্থতার পথকে সহজ করে। ভিটামিন-এ এবং বিটা ক্যারোটিনও সংক্রমণ থেকে দ্রুত মুক্তি দিতে অবদান রাখে।
দই
দইয়ে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে, যা হাড় ও ত্বককে সুস্থ রাখতে পারে। সুস্থ টিস্যু হলো সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা। ত্বক সুস্থ থাকলে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দই খেলে অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় থাকে।
আদা
আদায় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তরকারিতে বা চায়ে গোটা আদা ব্যবহার সবচেয়ে উপকারী।
রসুন
স্বাস্থ্যের উপকার বিবেচনায় শতশত বছর ধরে রসুনের ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি হৃদরোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ফ্লু ও ঠান্ডাজ্বরে উপকারী বলে ধারণা করা হয়। রঙ চায়ে রসুনের নির্যাস মিশিয়ে পান করতে পারেন।
হলুদ
হলুদ শরীরের রোগদমন ক্ষমতা বাড়াতে পারে। শীতকালে হলুদ চা বা হলুদ পানি পান করতে পারেন। অথবা তরকারিতে হলুদের ব্যবহার বাড়াতে পারেন।
পুদিনা
একাধিক উপকারিতা রয়েছে পুদিনা পাতায়। শরীর ভালো রাখতে মিন্ট বা পুদিনার রস খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের স্যালাদ, জুস বা চাটনিতে ব্যবহার করা যেতে পারে পুদিনা। কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, মুখের দুর্গন্ধ, ঠান্ডা লাগা, অবসাদসহ একাধিক সমস্যায় কাজে দেয় পুদিনা।
কলা
প্রতিদিন একটি করে কলা খাওয়ার অভ্যাস করুন। ভিটামিন বি-এর পাশাপাশি কলায় থাকে বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার। তাই শীতের এই সময়ে উপকারী একটি খাবার হতে পারে কলা।
মাছ ও শিম
শীতে বেশি করে মাছ খান। আমিষের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন দুই বেলা মাছ খান। খাবারে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন সামুদ্রিক মাছ রাখুন। এ ছাড়া মাছের সঙ্গে শিম যুক্ত করে খেতে পারেন। মাছের ঝোলে শিম মানিয়ে যায়। ভর্তা হিসেবেও অনন্য। শিম শুধু রসনাবিলাসই করে না, তার অন্য গুণও আছে। মাছ-মাংস খাওয়া হয় না, তাঁদের জন্য শিমের বিচি শরীরে প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারে। আর এই শীতে নিয়মিত শিম খেলে ত্বকও ভালো থাকবে।
ধনেপাতা
রান্নাঘরের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য উপাদান ধনেপাতা। ধনেপাতার মধ্যে ভিটামিন এ, কে, সি ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও একাধিক খনিজ লবণ থাকে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও মোক্ষম দাওয়াই এটি।
মুরগির কলিজা
মুরগির কলিজা খেতে ভালোবাসেন অনেকেই। শীতের সময়ে আপনার জন্য আরও বেশি উপকারী হয়ে উঠবে মুরগির কলিজা। ভিটামিন বি ছাড়াও এতে আছে প্রচুর ফোলেট ও আয়রন। এই খাবারের আছে অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা।
মটরশুঁটি
শীতের সময়ের আরেকটি সহজলভ্য সবজি হলো মটরশুঁটি। মটরশুঁটিতেও থাকে প্রচুর ভিটামিন বি। এই সবজি খেলে পাওয়া যায় আরও অনেক উপকারিতা। সালাদের সঙ্গে রাখতে পারেন এটি। সেদ্ধ মটরশুঁটি আরও অনেক খাবার তৈরিতে ব্যবহার করতে পারেন।
বাদাম-খেজুর
শীতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সুস্থ থাকতে শীতে বাদাম ও খেজুর বেশি খেতে পারেন। এসব খাবার প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরকে গরম রাখবে।