জীবনে জ্বর হয়নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। বিভিন্ন কারণেই শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এর প্রধান কারণ জীবাণুর সংক্রমণ।তাই জ্বর হলে শরীরে অন্য কোনো রোগ হলো কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের জ্বর হতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, নিউমোনিয়া, হাম, ফুসফুস ও প্রস্রাবের সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে জ্বর বেশি হতে পারে। এ ছাড়া টিকা গ্রহণ, ইনফেকশন, অস্ত্রোপচার, পানিশূন্যতা, তীব্র তাপের কারণেও শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে পারে।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গু একটি ভাইরাস। ভাইরাসজনিত রোগের সাধারণত কোনো প্রতিষেধক নেই। কিছু কিছু ভাইরাস রোগ টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। তবে ডেঙ্গুর এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক নেই। অন্যান্য ভাইরাল ফিভারের মতো এটিও সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়।
তবে মূল ভয়টা হচ্ছে এর পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে। যদি সময়মতো ডেঙ্গুর যথাযথ চিকিৎসা করা না যায়, তবে রোগীর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণকারী ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে।
এ জ্বরে অত্যধিক তাপমাত্রার জ্বরের জন্য দেহে দ্রুত পানিশূন্যতা দেখা দেয়। কোষের অভ্যন্তরীণ তরল কমে যায়, আশপাশের রক্তনালিতে চাপ পড়ে, শুরু হয় রক্তক্ষরণ। যা ইন্টারনাল ব্লিডিং নামে পরিচিত। বেশি মাত্রায় রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট সংখ্যায় কমে যায়। প্লেটলেট কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ আরো বাড়তে থাকে। দেখা দেয় শক সিনড্রোম। শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে রোগীর দ্রুত অবনতি ঘটে। রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়া জ্বরের কারণ আলফা ভাইরাস, যা টোগা ভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত। এটি সাধারণত মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়, এবং ডেঙ্গুর মতোই এর লক্ষণগুলো। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক। তবে অন্যান্য ধরনের মশার কামড়েও চিকুনগুনিয়া ছড়াতে পারে, যদিও তা কম মাত্রায়। চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, বমি ভাব, মাংসপেশি ও জয়েন্ট ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং বমি। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো চিকুনগুনিয়ায় জয়েন্ট ফুলে যায়, কিন্তু ডেঙ্গুতে এমনটা দেখা যায় না। এডিস মশার কামড়ানোর তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে চিকুনগুনিয়া জ্বর দেখা দিতে পারে, যা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে জয়েন্ট ব্যথা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। সাধারণভাবে একবার চিকুনগুনিয়া হওয়ার পর পুনরায় এই জ্বর হওয়ার আশঙ্কা কম, কারণ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই এবং কোনো টিকা নেই। জ্বরের উপশমের জন্য প্যারাসিটামল এবং প্রচুর তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত, তবে অ্যাসপিরিন ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত। চিকুনগুনিয়া জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষা না করেও লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়। এই জ্বরে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম বা অত্যন্ত বিরল।
ভাইরাল ফিভার
ভাইরাল ফিভার, বা ভাইরাস জ্বর, বছরের যে কোনো সময় হতে পারে এবং এটি ভাইরাস জীবাণুর সংক্রমণের কারণে ঘটে। সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হওয়া, শরীরের নানা অংশে এবং হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথা ব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব, এবং ত্বকে র্যাশ দেখা দেওয়া। জ্বরও সাধারণত বৃদ্ধি পায়, যা অতিরিক্ত হলে খিঁচুনি হতে পারে। এই অবস্থায় দ্রুত জ্বর কমানোর জন্য শরীর ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে হবে এবং মাথায় পানি দিতে হবে। রোগীকে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখার পরিবর্তে বাতাসযুক্ত জায়গায় রাখুন। জ্বর ও শরীরের ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ব্যবহার করুন। যদি জ্বর খুব বেশি (১০২-এর উপরে) হয়, তবে মলদ্বারে প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ব্যবহার করা যেতে পারে। তরল খাবার যেমন খাবার স্যালাইন, ফলের রস, শরবত ইত্যাদি বেশি পরিমাণে খেতে হবে এবং অন্যান্য স্বাভাবিক খাবারও নিয়মিত খেতে হবে। অন্য উপসর্গের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ সাধারণভাবে এই ধরনের জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন হয় না।
সংক্রামক ভাইরাল ফিভার যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, পক্স, মাম্পস ইত্যাদির ক্ষেত্রে রোগীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত যাতে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়। রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন এবং রোগীর কাপড় ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া একটি বিশেষ ধরনের মশার কামড়ে হয়ে থাকে। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সম্ভব। ম্যালেরিয়ার রোগীরা সাধারণত বারবার জ্বর ও কাঁপুনি অনুভব করেন এবং এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ম্যালেরিয়া সাধারণত স্ত্রী এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। যখন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত একজন ব্যক্তি মশার কামড়ে পড়ে, তখন মশাটি জীবাণু গ্রহণ করে। এরপর সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে, ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়া জীবাণু প্রবেশ করে এবং তিনি ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হন। গর্ভবতী মহিলারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে, তাঁদের গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যেও জীবাণু ছড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত দিলে নতুন সংক্রমণ হতে পারে।
ম্যালেরিয়া হলে সাধারণত তীব্র কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, শীতল অনুভূতি হয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, অতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে জ্বর কমে, এবং তীব্র ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভূত হয়। এছাড়া মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, এবং ডায়রিয়াও হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করে সঠিক ওষুধ নিতে হবে। যদিও ম্যালেরিয়ার ওষুধ সহজলভ্য, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদীভাবে সেবন করতে হয়। ম্যালেরিয়ার জটিলতা এড়াতে রোগীকে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।
টাইফয়েড
টাইফয়েড জ্বরের জন্য দায়ী স্যালমোনেলা টাইফি বা ব্যাসিলাস টাইফোসা নামক ব্যাকটেরিয়া। সাধারণত দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। টাইফয়েড হলে তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, পায়খানার সমস্যা, ডায়রিয়া, এবং চামড়ায় লালচে দানা বা র্যাশ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া শরীরের ওজন কমে যেতে পারে, পেট ফুলতে পারে বা ফাঁপতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগী প্রলাপও বকতে পারে। সঠিক রক্ত পরীক্ষা করে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। বর্তমানে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের জন্য একটি টিকা উপলব্ধ রয়েছে, যা সবাই গ্রহণ করতে পারেন।Healthx BD