থাইরয়েড, ডায়াবেটিসের মতোই গুরুতর একটি রোগ:
বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটির ও বেশি মানুষের থাইরয়েড জনিত রোগ রয়েছে । সহজে চিকিৎসাযোগ্য এই রোগটি ডায়াবেটিসের মতোই গুরুতর। এসোসিয়েশান অফ ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজিষ্ট এন্ড ডায়াবেটোলজিষ্ট অফ বাংলাদেশ এর মতে এই রোগে আক্রান্ত অর্ধেক মানুষই এ রোগ সর্ম্পকে তেমন ধারণা না থাকার কারণে ভুগে থাকেন।
থাইরয়েড কী:
থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান গলায়। প্রজাপতি আকৃতির এই গ্রন্থি শরীরে বেশ কয়েকটি হরমোন উৎপন্ন করে। যা শরীরের অনেক কাজ করে।
এই হরমোন
- শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু ও অঙ্গের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে;
- বিপাকের হার,
- হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা,
- হজমের প্রক্রিয়া,
- পেশি ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
তাই থাইরয়েডের সমস্যা হলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েডের ধরণ এবং লক্ষণ:
কয়েক ধরনের থাইরয়েড সমস্যা দেখা যায়। যেমন :
১. থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা বা হাইপোথাইরয়ডিজম:
এই অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি খুব কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে। হাইপোথাইরয়ডিজম এর লক্ষণ গুলো হলো অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি, সব সময় ক্লান্তিবোধ, অনিয়মিত মাসিক বা দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মাসিকের মতো সমস্যা, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া , শীত শীত ভাব , রক্তচাপ বাড়া, ,চুল ও ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বারবার গর্ভপাত, বন্ধ্যত্বসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। অন্যদিকে এতে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, বয়ঃসন্ধি বিলম্ব হয় ও মানসিক বিকাশে সমস্যাও দেখা দেখা দিতে পারে।
২. হরমোন বেশি নিঃসরণ হওয়া বা হাইপারথাইরয়েডিজম:
এই অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি বেশি কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে এতে শারীরিক বিপাকীয় প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। হাইপারথাইরয়ডিজম রোগে থাইরয়েড গ্লান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থাইরয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে প্রচণ্ড গরম লাগা, হাত পা ঘামা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন পায়খানা হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।ঋতুচক্রে কম রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। থাইরয়েডে সমস্যার কারণে মাংসপেশির ক্ষয় বেড়ে যায়, সক্ষমতা কমে যায়। চোখ বড় হয়ে যেতে পারে।
এ দুটি প্রধান সমস্যা ছাড়াও
৩. হাশিমোটো এর থাইরয়েডাইটিস:
এটি একটি অটোইমিউন ডিসঅরডার এবং থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ।এটি গলগন্ড (গলা ফুলে যাওয়া) বা অনান্য উপসর্গের কারণে হতে পারে।
৪.থাইরয়েড টিউমার:
থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে উঠে টিউমার হতে পারে।
৫.থাইরয়েড ক্যানসার:
থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে তা থেকে থায়রয়েড ক্যান্সার হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই ক্যান্সার নয়। থাইরয়েড ক্যান্সারে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে : গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠা। ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়। একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে। উভয় পাশে টিউমার হতে পারে, আশপাশের লিঙ্ক নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে। ওজন কমে যায়।খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে। তবে থাইরয়েড নোডিউল বা ক্যান্সার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে। শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। ক্যান্সার শনাক্ত হলে বা ক্যান্সার আছে এমন সন্দেহ হলে অতিদ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ বা থাইরয়েড অপারেশনে পারদর্শী কোনো সার্জনের কাছে যেতে হবে।
কারণ
নানা কারণে থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে।
১. থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে আয়োডিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আয়োডিন কম থাকলে থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হবে অথবা থাইরয়েড ফুলে যাবে। এই ফুলে যাওয়াকেই বলা হয় গলগণ্ড।
২. আবার জন্মগতভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির ত্রুটিতেও থাইরয়েডে সমস্যা দেখা দেয়।
৩. শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার ত্রুটি বা ইমিউনিটি ত্রুটি এবং অ্যান্টিবডি তৈরির কারণে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়।
৪. আবার গরভবতী মায়ের থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে তার সন্তানদেরও এ সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েড পরীক্ষা বা রোগ নির্ণয়
বয়স ৩৫ পেরোলে চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক প্রতি পাঁচ বছর পর পর থাইরয়েড পরীক্ষা করানো জরুরি।
উপসর্গ ছাড়াই চিকিৎসকেরা রক্তে ফ্রি থাইরক্সিন এবং টিএসএইচ (থাইরয়েড-স্টিমুলেটিং হরমোন) পরীক্ষা করতে দিতে পারেন। প্রয়োজনে থাইরয়েডের নানা অ্যান্টিবডি, গলার আলট্রাসনোগ্রাফি, রেডিও-আয়োডিন আপটেক পরীক্ষাও করতে হতে পারে। ক্যানসার সন্দেহ করলে সুই দিয়ে গলা থেকে টিস্যু নিয়ে বা বায়োপসি করার দরকার হতে পারে। নারীদের সন্তান নেওয়ার আগে ও গর্ভাবস্থায় উপসর্গ না থাকলেও থাইরয়েড পরীক্ষা করা নিরাপদ।
চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’। এই ওষুধ হয়ত সারাজীবন চালিয়ে যেতে হতে পারে এবং তা বেশিরভাগ সময় খালি পেটে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
প্রচুর ‘আয়রন’ ও ‘ক্যালসিয়াম’ আছে এমন খাবারে বিধিনিষেধ আসবে। কারণ এগুলো ওষুধের কার্যকারিতার পথে বাধা হতে পারে।
তবে চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি তাই ‘ফলো-আপ’ বাদ দেওয়া চলবে না। ওষুধ সেবনের সময় মানতে হবে কঠোরভাবে, আর শারীরিকভাবে ভালো লাগলেই ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না।
শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো মেনে চলার গুরুত্ব আরও বাড়বে। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েডে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। থাইরয়েড সন্দেহ হলে অবশ্যই একজন হরমোনবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
কাদের থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত সবার সম্ভাবনা বেশী:
থাইরয়েড রোগ যে কোন ব্যক্তির হতে পারে যেমন- পুরুষ, মহিলা, শিশু, কিশোর এবং বয়স্ক। এটি জন্মের সময়ও হতে পারে (সাধারণত হাইপোথাইরয়েডিজম) এবং এটি মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিকাশ হতে পারে যেমন মহিলাদের মেনোপজের পরে।
থাইরয়েড রোগ খুবই সাধারণ রোগ তবে রিসার্চ অনুযায়ী, মহিলারা পুরুষদের তুলনায় থাইরয়েড রোগে বেশি আক্রান্ত হন। এবং তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় পাঁচ থেকে আট গুণ বেশি।
থাইরয়েড প্রতিরোধে যা খেতে হবে
আয়োডিন আর সেলেনিয়াম থাইরয়েডের বন্ধু। তবে জিংক, আয়রন আর কপারও থাইরয়েডকে সচলভাবে তার কাজ সম্পন্ন করে যেতে সহযোগিতা করে থাকে।খাদ্য তাালিকায় নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম, পালংশাক, ডিম রাখতে পারলে শরীরে আয়োডিনের অভাব হবে না। এ ছাড়া ওয়েস্টার সস দিয়ে তৈরি খাবার, রান্নায় রসুন আর তিলের ব্যবহারও আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে থাকে। সেলেনিয়াম খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হলেও শরীরে এর জোগান নিয়মিতভাবে চাই-ই চাই। টুনাফিশ, মুরগি ও গরুর মাংস, কলিজা,এসব সেলেনিয়ামের ভালো উৎস।
বিভিন্ন ধরনের ডাল বিশেষ করে মটর ও ছোলার ডাল খাবারের তালিকায় থাকলে আয়রন, কপার আর জিংকের চাহিদা পূরণ হয়ে যায় সহজেই। ডাল ও বিভিন্ন ধরণের বাদামজাতীয় খাবার থাইরয়েডের কার্যক্ষমতাকে দারুণভাবে বাড়াতে সাহায্য করে। কুমড়ার দানা বা সূর্যমুখী ফুলের দানাও খাওয়া যেতে পারে।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়া উচিৎ। একেক দিন একেক সময় খাবার খেলে শরীরের মেটাবলিজম ঠিকভাবে কাজ করে না। তাই সকালেই নাশতা, স্ন্যাকস, দুপুরের ও রাতের খাবার একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে খেতে হবে এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাটা সহজ হয়।
প্রতিবেলার খাবারের তালিকায় অবশ্যই প্রোটিন রাখা দরকার। প্রাণিজ প্রোটিন কিংবা উদ্ভিজ প্রোটিনের যেকোনো উৎস থেকেই আমিষ নেওয়া যেতে পারে। সকালের নাশতায় ডিম অথবা দুধ, দুপুরে ও রাতের খাবারে ডাল, বীজ, মাছ বা মাংস রাখা জরুরি।
নিয়মিত আঁশজাতীয় খাবার যেমন শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে
থাইরয়েড প্রতিরোধে যা করা যাবে না
- প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলা: প্রক্রিয়াজাত খাবারের অনেক রাসায়নিক থাইরয়েড হরমোন তৈরীকে প্রভাবিত করতে পারে। যেকোন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলতে হবে। এই সমস্ত খাবারে লবণ, চিনি ও তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। যা দ্রুত ওজন বাড়াতে পারে। খাবারের তালিকা থেকে যতটা সম্ভব গ্লুটেন (আটা বা ময়দাজাতীয় খাবার) বাদ দিন। গ্লুটেন বেশি আছে এমন খাবারের মধ্যে কেক, পাউরুটি, মাফিন, পেস্ট্রি, কাপকেক, বিস্কুটের গুঁড়া দিয়ে তৈরি খাবার, আলুর চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, হটডগ, সসেজ, পিৎজা এগুলো পড়ে। এই ধরনের খাবার যত কম খাওয়া যায়, শরীরের জন্য ততই মঙ্গলজনক।
- থাইরয়েড হলে কিছু সবজি এড়িয়ে চলা: এ ছাড়া কিছু সবজি আছে যেগুলো থাইরয়েডের কাজকে ধীর করে দেয়। থাইরয়েড থাকলে ফুলকপি, বাঁধাকপি ,ব্রকোলি আর পালং শাক একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে কারণ এই শাকসব্জিতে গয়ট্রোজেন থাকে যা থাইরয়েড গ্রন্থির আয়োডিন শোষণে বাধা দেয় এবং হাইপারথাইরয়েডিজমকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
- সয়া পন্য এড়িয়ে চলা: সয়া পণ্য খাওয়া কমাতে হবে কারণ এটি থাইরয়েড হরমোন তৈরীকে প্রভাবিত করে। তাই সয়াবিন, সয়ার দুধ, টফুর মতো খাবার মেপে খাওয়াই ভালো।
- ধূমপান না করা :ধূমপানের সময় নির্গত টক্সিন থাইরয়েড গ্রন্থিকে বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে যা থাইরয়েড রোগের কারণ হতে পারে।
- মানসিক চাপ বা উদ্বেগ কমানো: থাইরয়েড রোগ সহ অনেক স্বাস্থ্য ব্যাধিতে মানসিক চাপের অবদান হল অন্যতম প্রধান। তাই জন্য সক্রিয় হতে হবে, ধ্যান ও যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমাতে হবে।