পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওএস নারীদের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জনিত রোগ। বিশ্বজুড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ নারী এই সমস্যায় ভোগেন। এই রোগে অনেকগুলো ডিম্বাশয়কে একত্রে সিস্ট বলা হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে বন্ধ্যাত্বের জন্য এই রোগকে বেশি দায়ী করা হয়ে থাকে।
পিসিওসের কারণ-
পিসিওসের প্রকৃত কারণ অজানা তবে মেটাবলিক ,হরমোনজনিত ,জেনেটিক ও পরিবেশকে কারণ হিসাবে ধরা হয়। PCOS একটি হরমোনাল অস্বাস্থ্য যা মেয়েদের শরীরে অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন হরমোন উৎপন্ন করে। এর ফলে মেয়েদের মাসিক চক্র বিঘ্নিত হয়, ডিম ফোঁটায় সমস্যা হয় এবং অন্যান্য সমস্যা যেমন চুল পড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত চুলের বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
আপনি যে রোগের বর্ণনা দিয়েছেন, তা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এর একটি বিস্তৃত ও বিস্তারিত বিবরণ। এ রোগের প্রধান লক্ষণ এবং কারণগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। সংক্ষেপে বললে:
- অতিরিক্ত ডিম্বানু এবং সিস্ট: PCOS এ, ডিম্বাশয়ে (ওভারি) অস্বাভাবিকভাবে ডিম্বানু জমা হয়, যার ফলে সিস্টের মতো ছোট ছোট পানির ব্যাগ তৈরি হয়। এই সিস্টগুলো আসলে কার্যকরী সিস্ট নয়, বরং ডিম্বাশয়ের ভিতরে জমে থাকা অমসৃণ ডিম্বানুর ফলস্বরূপ হয়।
- ঋতুচক্রের সমস্যা: নিয়মিত ডিম ফোটার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ঋতুচক্র বিঘ্নিত হয়। ফলে মাসিক সমস্যার পাশাপাশি বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ে।
- অ্যান্ড্রোজেনের আধিক্য: অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের কারণে অতিরিক্ত চুল বৃদ্ধি, চুল পড়া এবং ত্বকের সমস্যার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স: PCOS রোগীদের অনেক সময় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স দেখা যায়, যা গ্লুকোজের মেটাবলিজমে বিঘ্ন ঘটায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ওবেসিটি (অতিরিক্ত মেদ) ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে ত্বরান্বিত করে।
- বংশগততা এবং পরিবেশগত প্রভাব: PCOS বংশগত হতে পারে এবং মা, বোন বা অন্য নারীদের মধ্যে এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। খাদ্যাভ্যাস, লাইফস্টাইল ইত্যাদি পরিবেশগত বিষয়ও এই রোগের তীব্রতা বাড়াতে পারে।
উপসর্গ-
পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম) এর উপসর্গ সাধারণত নারীদের মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকেই দেখা দেয়, তবে এর উপসর্গ এবং তীব্রতা ব্যক্তি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।
সাধারণত যে উপসর্গটি সকলের মধ্যে দেখা যায়, তা হলো অনিয়মিত মাসিক। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
– মুখ, বুকে, পেটে অপ্রত্যাশিত লোমের বৃদ্ধি।
– ব্রণ, তৈলাক্ত ত্বক, বা খুশকি।
– অতিরিক্ত চুল পড়া বা পুরুষদের মতো টেকো ভাব।
– ঘাড়, হাত, স্তন, বা উরুর চামড়ায় গাঢ় বাদামি বা কালো দাগ, যা বগলে বা পায়ের ভাঁজেও দেখা যেতে পারে।
– মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি।
– বন্ধ্যাত্ব।
– কোলেস্টেরলের মাত্রার বৃদ্ধি।
– ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।
তবে এই উপসর্গগুলির সবগুলো প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে উপস্থিত নাও থাকতে পারে।
লক্ষণ –
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার (জরায়ু ক্যান্সার) ইত্যাদি স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
- পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এবং বন্ধ্যাত্ব – বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বন্ধ্যাত্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে PCOS প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে। তবে, PCOS থাকা মানে এই নয় যে একজন নারী কখনোই মা হতে পারবেন না। সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাপনের পরিবর্তন মাধ্যমে PCOS আক্রান্ত নারীরাও মা হতে পারেন। এই সমস্যাটি ধরা পড়লে হতাশ হওয়ার কিছু নেই; ধৈর্য সহকারে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সফলভাবে মাতৃত্ব অর্জন সম্ভব।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা-
পিসিওএসের লক্ষণ এবং তীব্রতার ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত হয়।
- ওজন এবং মানসিক চাপ: অতিরিক্ত ওজন এবং মানসিক চাপ PCOS এর লক্ষণগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে। তাই, জীবনযাপনে পরিবর্তন, যেমন সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম, PCOS-এর চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১০ শতাংশ ওজন কমানো হলে ডিম ফোটার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে এবং মাসিক নিয়মিত হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ, সঠিক সময়ে ঘুমানো, এবং মানসিক চাপ কমানো এসবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
- ব্যায়াম: সঠিক ওজন বজায় রাখতে এবং বিএমআই চার্ট অনুযায়ী সঠিক ওজন ঠিক করতে চিকিৎসকরা ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। এতে হাঁটা, জগিং, এবং যোগব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত।
- কিশোরীদের জন্য: এক ঘণ্টা নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন খেলাধুলা, সাইক্লিং, বা সাঁতার, বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিশোরীদের বর্তমানে শারীরিক কার্যকলাপ কম হওয়ায় PCOS-এর সংখ্যা বাড়ছে।
- খাদ্যাভ্যাস: সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করা উচিত এবং জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত মিষ্টি, এবং চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
- ঘুম: নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম PCOS প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, PCOS রোগীদের মেলাটোনিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থাকে, যা রাতে ঘুমানোর সময় নিঃসৃত হয়। রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে ঘুমানো হলে মেলাটোনিনের মাত্রা বজায় থাকে এবং PCOS এর লক্ষণগুলো কমে আসে।
- ঔষধ এবং চিকিৎসা: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোন জাতীয় ওষুধ, যেমন প্রোজেস্টেরন, ওরাল পিল, এবং মেটফরমিন ব্যবহার করা যেতে পারে। ওভুলেশন ইনডাকশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিম ফোটানোর জন্য বিশেষ মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। অবাঞ্ছিত লোমের জন্য ক্রিম, ওয়াক্সিং, বা লেজার ট্রিটমেন্ট করা যেতে পারে।
- জরায়ু ক্যান্সার: যারা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন, তাদের ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে।
একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ এবং এর সম্পূর্ণ নিরাময় এখনও সম্ভব হয়নি। তবে, জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ থাকা সম্ভব। সচেতনতা এবং নিয়মিত চিকিৎসা এ রোগের মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।Healthx BD