শিশুর জন্মের পর চাকরিজীবী মায়েরা পারিবারিক এবং অফিসের চাপের কারণে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন, এটি অনেকের কাছেই স্বাভাবিক। তবে নতুন বাবারাও একই ধরনের সমস্যায় পড়েন, যা অনেকের কাছে ধারণার বাইরে থাকতে পারে।
অনেক নারীর ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিজ্ঞতা শোনা যায়। শিশুদের যত্নে মায়েরা সাধারণত প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং পেশা ও পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে তাদের দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। তবে অনেক বাবাকেও এই ধরনের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়, কারণ তাদের নিয়মিত চাকরির পাশাপাশি অন্য কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে।
- চিন্তা বা উদ্বেগ বাড়ছে
সেন্টার ফর প্যাটারনাল লিভ লিডারশীপের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামি বিকম মাইক্রোসফট ও ফিলিপস ৬৬-র মতো প্রতিষ্ঠানে পিতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেন। তিনি উল্লেখ করেন, সদ্য মা হওয়া নারীরা যে চাপ অনুভব করতেন, তা এখন বাবাদেরও সহ্য করতে হচ্ছে। তাদের কাজ আর শুধু সংসারের জন্য অর্থ উপার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
“এখন আশা করা হচ্ছে, বাবারাও বাড়িতে সময় দেবেন। এর ফলে তাদের চাপ, বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে,” বলেন বিকম।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠানের কাছে পরামর্শ দেন যেন তারা নতুন বাবাদের মানসিক অবস্থার বিষয়ে নজর দেয়, যা গর্ভাবস্থার পর থেকে মা-বাবার মধ্যে অন্তত এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।
- পরিবর্তনের চিত্র
অনেক কোম্পানি এখন নতুন বাবাদের সমস্যাগুলো মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিচ্ছে। “শিশুদের জীবনে পুরুষরা আগের চেয়ে অনেক বেশি জড়িত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কর্মঘণ্টায় কোনও পরিবর্তন আসেনি,” বলেন কিরি স্তেজকো, প্যারেন্টস এট ওয়ার্কের প্রধান সেবা কর্মকর্তা।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং হংকংয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মা-বাবাদের কর্মজীবন ও পরিবারের মধ্যে সমন্বয় সাধনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ডেলোইট এবং এইচএসবিসির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার পর তিনি জানিয়েছেন, চাকরি দাতারা বিষয়টিকে আর নারীদের বা শিশুদের সমস্যা হিসেবে নয়, বরং পরিবার ও অভিভাবকদের সমস্যা হিসেবে দেখতে চাইছেন।
পূর্বে বিভিন্ন সুবিধা, যেমন সদ্যজাতের যত্নের জন্য ছুটি বা কাজের সুবিধার ব্যবস্থা, শুধুমাত্র নারীদের কথা চিন্তা করেই করা হতো। অনেক পুরুষও শিশুর যত্ন নিতে চাইলে কাজের পরিবেশে পরিবর্তন আনতে চান, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি গ্রহণযোগ্য হয় না, জানান স্তেজকো।
বহু পুরুষ মনে করেন, কাজ থেকে বিরতি নেওয়া বা সহায়তার জন্য আবেদন করলে তা তাদের ক্যারিয়ারে ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। পাঁচ সন্তানের বাবা অ্যালেক্স লাগুনা একই উদ্বেগে ভুগছেন। তিনি একটি ওয়েবসাইট শুরু করেছেন, ‘বেটারড্যাডস’, যেখানে শুরুর দিকে পুরুষদের বিচ্ছেদের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হতো, এখন সেখানে কর্মজীবন ও পরিবারের বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়। লাগুনা বলেন, কাজ থেকে বিরতি নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পুরুষ সমস্যায় পড়েন এবং ভাবেন, সহকর্মীরা বিষয়টি কিভাবে নেবেন।
“চাকরিতে না বলাটা আসলে শক্ত স্নায়ুর বিষয়,” বলেন সিডনি ড্যাড। ৪৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তি, যিনি একটি আলোকসজ্জা কোম্পানি পরিচালনা করেন, জানান যে তার প্রজন্মের মানুষরা পরিবার ও কাজের মধ্যে সমন্বয়ের আদর্শ বা রোল মডেল দেখতে পাননি। “আমরাই প্রথম এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে,” তিনি বলেন।
আলোচনা শুরু করা
চাকরিরত পিতাদের সহায়তায় কোম্পানিগুলোর এগিয়ে আসাকে স্বাগত জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে।প্যারেন্টাল অ্যাংজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টেরি স্মিথ বলছেন, শিশুর জন্ম হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট মানসিক সমস্যায় যে পুরুষরাও আক্রান্ত হতে পারে, এটা অনেক মানুষই জানে না-ফলে তাদের জন্য কোন সহায়তাও দেয়া হয় না।তিনি বলছেন, প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত এটাকে সত্যিকারের একটি অসুস্থতা বলে স্বীকৃতি দেয়া এবং এ নিয়ে অফিসে আলোচনা শুরু করা।
সন্তানের জন্মের পর ওয়েলসের মার্ক উইলিয়ামসন মানসিক সমস্যায় পড়েন এবং উপলব্ধি করেন যে, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ প্রশিক্ষকের চাকরি করাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।এরপরে তিনি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘ফাদারর্স রিচিং আউটের’ প্রতিষ্ঠা করেন যেটি যুক্তরাজ্য জুড়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে।”এটা আসলে শুধুমাত্র বিষণ্ণতা নয়, পুরুষরা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারেও ভুগতে পারে” তিনি বলছেন।
”আপনি হয়তো এর মধ্যেই বাড়িতে মানসিকভাবে অসুস্থতার শিকার হয়েছেন, যার সবকিছু হয়েছে অনেকটা আকস্মিকভাবে। আর শিশুর জন্মের দুই সপ্তাহ পরেই তাকে আবার কাজে যোগ দিতে হচ্ছে।”
তিনি বলছেন, ব্যবস্থাপক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উচিত নতুন বাবা হওয়াদের জিজ্ঞেস করা যে, তাদের কেমন লাগছে এবং প্রয়োজনে সহায়তার ব্যবস্থা করা।
তার সাথে একমত এডওয়ার্ড। তিনি মনে করেন, কাজে ফেরার পর যদি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার একটু খোঁজখবর নিতেন, তাহলে তিনি অনেক উপকৃত হতেন।”বাড়িতে কি অবস্থা, তোমার সঙ্গী এখন কেমন আছে, এরকম অনেক কিছু আমি শুনেছি, কিন্তু আমার ব্যাপারে কেউ কখনো জানতে চায়নি,” তিনি বলছেন।
জনসেবা খাতের এই কর্মী বলছেন, তিনি এখন খুব ভালো অবস্থায় রয়েছেন এবং অন্যদের সহায়তা করার চেষ্টা করছেন।”কীভাবে নিজেদের দেখভাল করতে হবে, নতুন বাবাদের সেটা দেখিয়ে দেয়া খুব জরুরি, কারণ সেরকম কষ্টের কিছু মাস আমি পেরিয়ে এসেছি….এটা ভালো লাগার মতো কিছু নয় এবং আমি জানি, সেটা আমার কাজের ওপরেও অনেক প্রভাব ফেলে” তিনি বলছেন।Healthx BD
আরও জানুন-
–প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা নিয়ে কিছু কথা