ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কমন রোগগুলির মধ্যে একটি।ডায়াবেটিস বিষয়ে আমাদের অনেকের মাঝে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকীয় রোগ। দিন দিন এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।ডায়াবেটিস হলে রক্তের শর্করা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।মূলত ইনসুলিনের ঘাটতিই হলো এর মূল কথা।ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, বংশগত ধারা ইত্যাদি কারণে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়াবেটিস আগে ৪০ বছরের উপরে দেখা যেত। এখন সব বয়সের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এমনকি বয়ঃসন্ধিকালের অল্প বয়সীদেরও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আগের তুলনায় বেশি।ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র আস্তে আস্তে বিকল হতে থাকে। তবে এ রোগ নিয়ে আমাদের সবার মাঝে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।কয়েকটি ভুল ধারণা নিয়ে কথা বলা যাক।
চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয়
প্রচলিত এই ধারণাটি ভিত্তিহীন।অনেকে মনে করেন, মিষ্টি খেলে বা মিষ্টি খেলে অথবা টেনশন করলে ডায়াবেটিস হয়। চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয় কথাটির আসলে প্রত্যক্ষ কোনও ভিত্তি নেই। তবে পরোক্ষ কিছু সংযোগ রয়েছে। তবে মিষ্টিজাতীয় খাবার উচ্চ ক্যালরিযুক্ত, যা ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর ওজন বাড়লে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ে। আর অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, কোল্ড ড্রিংক, ডেসার্ট বা রিচ ফুড খেলে আমাদের ওজন বেড়ে যায়। সে হিসেবে চিনির সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকির একটি সম্পর্ক রয়েছে। অত্যধিক চিনি গ্রহণ রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে।টাইপ-১ ডায়াবেটিস খাবার বা জীবনযাত্রার ধরনের কারণে হয় না। বরং আমাদের দেহের অগ্ন্যাশয়ে থাকা ইনসুলিন তৈরি করে, এমন বিটা কোষগুলো যখন অকার্যকর হয়ে যায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না, তখন টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। অন্যদিকে অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক পরিশ্রম না করা—মূলত এই দুটি কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর মিষ্টি বা গ্লুকোজ-সমৃদ্ধ খাবার খেলে ইনসুলিনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে শরীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।
স্থূলতাই ডায়াবেটিসের মূল কারণ
মোটা মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূল হওয়া টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণ, তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। সব মোটা মানুষেরই ডায়াবেটিস হবে কিংবা শুকনা পটকাদের কখনই ডায়াবেটিস হবে না। তবে মোটা মানুষদের খুশি হওয়ারও কোনো কারণ নেই। সব মোটাদের ডায়াবেটিস না হলেও হাই ব্লাড প্রেশার সহ অন্যান্য রোগ হতে পারে।জেনেটিক প্রবণতা, জীবনধারা এবং অন্যান্য কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে।
ডায়াবেটিস শুধু বড়দের হয়
ডায়াবেটিস কেবল বুড়োদের রোগ নয়। এই ধারণার ভিত্তি নেই। আজকাল অনেক তরুণরাও ভুগছেন ডায়াবেটিসে। ডায়াবেটিস দুই রকমের হতে পারে। টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ -১ ডায়াবেটিস সাধারণত অল্প বয়সে বা ৩০ বছরের আগে হয়। অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত বয়স ৪০-এর পরে হয়। যদিও টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে এটি ক্রমবর্ধমানভাবে শিশু এবং অল্প বয়স্কদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার ভুলেই এমনটি হচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
শুধু ওষুধ বা ইনসুলিন নিলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটাহাঁটি এবং খাবার ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ করা। হাঁটাহাঁটি করলে শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, ওজন কমে, ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগজনিত জটিলতা কমে।ডায়াবেটিস হলে সবসময় ওষুধ খেতে হবে এই ধারণা সঠিক নয়। তাই কার্যকরভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য খাবারে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও ওষুধ গ্রহণ—সবকিছুই মেনে চলতে হবে। যেকোনো একটি করলে হবে না।ইনসুলিন ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ চিকিৎসা। তাই ইনসুলিন দেওয়া মানেই রোগীর অবস্থা খুব জটিল, এমন ভাবার কারণ নেই। টাইপ ২ সহ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে ইনসুলিন নিতে পারেন।
ডায়েট, ব্যায়াম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখলে সুস্থ থাকা সম্ভব।
ফল খাওয়া যাবে না
ফল একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। কেক, বিস্কুট ও মিষ্টির চাইতেও কম চিনি থাকে ফলের মধ্যে। এ ছাড়া ফলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ও আঁশ রয়েছে। যেসব ফল ডায়াবেটিক রোগীরা খেতে পারবেন, তার মধ্যে আছে আপেল, নাশপাতি, আভোকেডো, পেঁপে, শসা, পেয়ারা, লেবু, তরমুজ, আঙুর, টমেটো, স্ট্রবেরি, কালোজাম ইত্যাদি।
ডায়াবেটিস রোগীরা কার্বোহাইড্রেট খেতে পারেন না
অনেকেই মনে করে, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সব সময় উচিত খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণে রেখে যতটা সম্ভব কম পরিশ্রম করা। এই ধারণাটিও সঠিক নয়।কারণ নিয়ম মেনে চললে আর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব। ডায়াবেটিস ধরা পড়লে স্টার্চ বা শর্করা জাতীয় খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না, এমনটাই ধারণা বেশিরভাগ মানুষের। তবে বাস্তবে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করাকে প্রভাবিত করে, তবে এটি সুষম খাদ্যের অপরিহার্য অংশ। পরিমিত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট খেলে কোনও ক্ষতি নেই। পুরো শস্য, ফল এবং শাকসবজির মতো স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট নির্বাচন করতে হবে। কখনোই শর্করা জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া উচিত নয়। বরং কম পরিমাণে খাওয়া উচিত।