শীতে শিশুদের নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঠান্ডা মৌসুমে ঘরের অ্যালার্জেন, শুষ্ক বাতাস ও ভাইরাস সংক্রমণে সর্দি জমে সহজেই নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।সমস্যা হলো, শিশুরা নিজে নিজে নাক পরিষ্কার করতে পারে না। অস্বস্তি বোধ করায় কান্নাকাটি শুরু করে দেয় ও বিরক্ত করে।
শীত বা মৌসুম পরিবর্তনের সময়টাতে ছোট শিশু, বিশেষত এক বছর বয়সীরা হঠাৎ ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া, সর্দি জমে থাকার মতো সমস্যার শিকার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব উপসর্গ ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের সংক্রমণ অল্পবয়সী শিশুদের বছরে প্রায় ছয় থেকে আটবার দেখা দেয়। এমনকি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিশুদের মধ্যে তা বছরে প্রায় ১২ বার পর্যন্ত হতে পারে। শিশুর এ ধরনের সমস্যায় অনেকেই বিনা প্রেসক্রিপশনে অহরহ বিভিন্ন ধরনের নাকের ড্রপ ও স্প্রের ব্যবহার করে থাকেন। যদিও সম্প্রতি প্রকাশিত মেডিকেল জার্নালের নিবন্ধে বলা হয়েছে, নাকের এসব ড্রপ ও স্প্রের ব্যবহারে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত সমস্যা
শিশুর অত্যধিক ঝিমুনি, পেটের সমস্যা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, খিঁচুনি, যন্ত্রণা ভাব, অস্বস্তি ভাব বা নাকের ভেতর শুষ্ক ভাব, মাথাব্যথা প্রভৃতি হতে পারে। অধিক সময় ধরে ওষুধ ব্যবহারের ফলে ভ্যাসোডাইলেটেশনের (ওষুধ প্রভাবিত নাসারন্ধ্রের শ্লেষ্মা ঝিল্লির প্রদাহ) পুনরাবৃত্তি ও নিদ্রা ভাব হতে পারে। নাকের ড্রপগুলোর ক্ষেত্রে আরেকটি অসুবিধা হলো এগুলোর নাম এবং প্যাকেট একই দেখতে হলেও ছোট ও বড়দের ক্ষেত্রে এ ড্রপগুলোর ব্যবহারের মাত্রার ভিন্নতা আছে। অনেক সময়ই অসাবধানতায় বড়দের ড্রপ ছোটদের দিয়ে দেওয়া হয়।
ন্যাজেল ড্রপস
এটি একধরনের আইসোটোনিক দ্রবণ, যা নাকের ভেতরে অবস্থিত শক্ত মিউকাস পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রতি মিলিতে আছে সোডিয়াম ক্লোরাইড বিপি ৯ মিলিগ্রাম। এটি অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, সাইনাস ইনফেকসন এবং বিভিন্ন ধরনের ঠান্ডাজনিত সমস্যায় নাক পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করা হয়।
অক্সিমেটাজোলিন ন্যাজেল ড্রপস
অ্যালার্জি ও ইনফেকশনজনিত নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লির প্রদাহ, সাইনোসাইটিস, সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য এই ড্রপস ব্যবহার করা হয়। দুই থেকে তিন ফোঁটা করে দিনে দুবার নাকের ভেতর প্রয়োগ করতে হবে। মাথা নিচের দিকে রেখে প্রথমে নাকের এক ছিদ্রের ভেতর, এরপর অপর ছিদ্রের ভেতর দিতে হবে। এর ফলে রোগীর ওষুধ গিলে ফেলার আশঙ্কা কমে যায়। চিকিৎসার মেয়াদ তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং কোনো অবস্থাতেই দুই সপ্তাহের বেশি সময় চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
নেজ্যাল স্প্রে
শিশুদের অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিলে, সেখান থেকে হাঁচি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেয়। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত আরাম পেতে অনেকে নেজ্যাল স্প্রে ব্যবহার করেন। ভেপার বা বাষ্প নিলেও বন্ধ নাক খুলে যায়। কিন্তু তাতে সময় লাগে বেশি। স্প্রে বারবার ব্যবহার করলে বারবার শ্বাস নেওয়ার ফলে ভেতরের ত্বক শুষ্ক হয়ে রক্ত বের হওয়া, মাথাব্যথা ও নাক ফুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই স্প্রের ব্যবহার আসক্তি তৈরি করে, যা দীর্ঘ মেয়াদে নাক এবং শরীরের ক্ষতি করে।
এখানে নবজাতক থেকে চার বছর পর্যন্ত শিশুদের নাক বন্ধে করণীয় উল্লেখ করা হলো।
স্যালাইন ড্রপ ব্যবহার করুন: যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের মতে, শিশুদের বয়স ৪ বছর পূর্ণ না হলে নাকের ডিকনজেসটেন্ট ড্রপ বা স্প্রে ব্যবহার করা যাবে না। নবজাতক ও অল্পবয়সী শিশুদের জন্য স্যালাইন ড্রপ হলো, নাকের একমাত্র নিরাপদ স্প্রে। বাজারে স্যালাইন নাকের ড্রপ কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া বাসায় আধা কাপ কুসুম গরম পানিতে চা-চামচের ৪ ভাগের ১ ভাগ লবণ গুলে স্যালাইন ড্রপ তৈরি করতে পারেন। আপনার শিশুকে চিৎ করে শোয়ানোর পর নাকের প্রত্যেক ফোঁটায় দুই-তিন ফোঁটা স্যালাইন ড্রপ দিন। নাকের ভেতর থেকে স্যালাইন ড্রপ অথবা সর্দি বের হয়ে আসলে টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলুন। নবজাতকের ক্ষেত্রে, স্যালাইন ড্রপ দেওয়ার পর বাল্ব সিরিঞ্জ দিয়ে নাকের সর্দি বের করে ফেলুন। অভিজ্ঞ কারো থেকে বাল্ব সিরিঞ্জের ব্যবহারবিধি জেনে নিন।
বাথরুমকে বাষ্পায়িত করুন: বাথরুমে কিছু মিনিট হট শাওয়ার চালু রাখুন। তারপর বাথরুম বাষ্পে পরিপূর্ণ হলে আপনার শিশুকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকুন। এতে নাকের সর্দি পাতলা হবে। সাবধান, শিশুকে হট শাওয়ারে গোসল করাবেন না। অন্যথায় ত্বক পুড়ে যাবে।
হিউমিডিফাইয়ার চালু করুন: শীতের ঠান্ডা তাড়াতে অনেকেই ঘরের উষ্ণতার জন্য যা করা প্রয়োজন তা করেন। কিন্তু হিটার চালু করলে শুষ্ক বাতাসে শিশুদের নাক বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিও আছে। শিশুদের নাক বন্ধ হয়ে গেলে এবং হিটার চালু রাখলে সমস্যাটি আরো বেড়ে যাবে। অন্যদিকে হিটার বন্ধ করে হিউমিডিফাইয়ার চালু করলে ঘরের বাতাসে আর্দ্রতা যোগ হবে। এতে আপনার শিশুর নাকের সর্দি পাতলা হবে ও স্বস্তি পাবে। এটা রাতে বিশেষ কার্যকরী। ছত্রাক প্রতিরোধে হিউমিডিফাইয়ারকে পরিষ্কার রাখতে হবে।
পানি পান করান ও বিশ্রামে রাখুন: শরীরের ডিহাইড্রেশন এড়াতে শিশুদেরকে পর্যাপ্ত পানি পান করাতে হবে। ডিহাইড্রেশনে বন্ধ নাকের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। শীতে শিশুরা পানি পানে তীব্র অনীহা দেখায়। তাই তাদেরকে পর্যাপ্ত পানি পান করানোর চেষ্টা করতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পান করছে কিনা সেই খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা অসুস্থ হলে বেশি করে ঘুমানোর প্রয়োজন পড়ে। ঘরের পরিবেশকে নির্বিঘ্ন ঘুমের উপযোগী করে তুলুন। পর্যাপ্ত বিশ্রামে শারীরিক অসুস্থতা দ্রুত সেরে যায়।
কখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন?
শিশুদের নাক বন্ধ হয়ে গেলে দুশ্চিন্তা করবেন না। সাধারণত ঘরোয়া চিকিৎসায় তিন-চার দিনে নাক খুলে যায়। তবে আপনার শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাস কঠিন হলে, বুকের ভেতর থেকে অস্বাভাবিক শব্দ বের হলে, দুধপানে অনীহা দেখালে, খাবার খেতে না চাইলে অথবা জ্বরের মাত্রা উদ্বেগজনক হলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চার-পাঁচদিনে নাক পরিষ্কার না হলেও চিকিৎসক দেখানো ভালো। তিনি নাক খোলানোর যথাযথ উপায় বলে দিতে পারেন।