বাড়তি ওজন বা স্থুলতা একটি ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী মহামারী। স্থুলতা এমন একটি অবস্থা যা কোনো ব্যক্তির ওজন বৃদ্ধির সাথে সংযুক্ত। বাড়তি ওজন অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যের অবস্থার অবনতি ঘটায়। একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার সাধারণত তখনই রোগীর স্থুলতা সনাক্ত করতে পারে যখন রোগীর বডি মাস ইনডেক্স (BMI) এর হার বেশি হয়ে থাকে।
বডি মাস ইনডেক্স (BMI) হলো শরীরের উচ্চতা ও ওজনের আনুপাতিক হার, যা দিয়ে বোঝা যায় যে কোনো ব্যক্তি তার বয়স, লিংগ ও উচ্চতার তুলনায় মাত্রাধিক ওজন বিশিষ্ট কিনা। কোনো ব্যক্তির BMI যদি ২৫ থেকে ২৯.৯ এর মধ্যে থাকে তাহলে ব্যক্তি অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট ধরা হয় আর যদি BMI ৩০ অথবা ৩০ এর বেশী হয় তবে সেই ব্যক্তির স্থুলতা আছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়৷
কিছু অন্যান্য কারণ যেমন: ব্যক্তির শারীরিক গঠন, উচ্চতা, হাড়ের ঘনত্ব, শরীরে চর্বির পরিমাণ ও বিতরণের উপর নির্ভর করেও তার ওজন কতটা স্বাস্থ্যকর তা নির্ণয় করা যায়।
কোনো ব্যক্তির যদি স্থুলতা থাকে তাহলে তার নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন: বাত, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সহনীয় ওজন বজায় রাখা, বা স্বাস্থ্যকর উপায়ে ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে ওজন কমানোর মাধ্যমে স্থুলতা প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার করাতে হতে পারে।
বাড়তি ওজন বা স্থুলতার কারণসমূহ:
১. অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহন করা: যখন কোনো ব্যক্তি তার শরীরের প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহন করে তখন সেই অতিরিক্ত ক্যালোরি চর্বি হিসেবে শরীরে জমা হতে থাকে। যা পরবর্তীতে স্থুলতা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু খাবার এবং পানীয় আছে যা উচ্চমাত্রার চর্বি ও চিনি ধারণ করে এবং তা গ্রহণ করলে ওজন বাড়ে। যেসব খাবার গ্রহনে ওজন বাড়তে পারে তা হল:
- ফাস্ট ফুড
- তেলে ভাজা খাবার
- প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস
- বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য
- প্যাকেটজাত খাবার যেমন: চিপস, কুকিজ, পাউরুটি, খাদ্যশস্য
- মিষ্টিযুক্ত ফলের রস, সোডা, অ্যালকোহল যুক্ত পানীয়
- কিছু প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য যেমন কেচাপ/সস যার মধ্যে অতিরিক্ত ফ্রুক্টজ যুক্ত ভূট্টার সিরাপ ব্যবহৃত হয়
উপরোক্ত খাবার সমূহ বেশী মাত্রায় গ্রহণ করলে এবং পর্যাপ্ত শরীরচর্চা না করলে ওজন বাড়ার এবং স্থুলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
তবে যারা স্বাস্থকর খাবার যেমন: ফলমূল, শাকসবজি, আঁশযুক্ত খাবার, কম চর্বিযুক্ত মাছ-মাংস গ্রহণ করে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করে তাদের মধ্যেও ওজন বাড়ার ঝুঁকি থাকে যদি তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাওয়াদাওয়া করে অথবা কোনো জেনেটিক কারণ থেকে থাকে। কিন্তু, তাদের ক্ষেত্রে একটি বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাসের সাথে পর্যাপ্ত ওজন বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি কাজ করে।
২. অলস জীবনযাত্রা: অনেক মানুষ বর্তমানে তার পূর্বপুরুষদের তুলনায় নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করে থাকে। অলস জীবনযাত্রার কিছু উদাহরণ হল:
- কায়িকশ্রমের পরিবর্তে অফিসে কাজ করা
- বাইরে খেলাধুলার পরিবর্তে ঘরে বসে মোবাইল বা কম্পিউটারে গেম খেলা
- হাঁটা বা সাইকেল চালানোর পরিবর্তে যাতায়াতের জন্যে বাস, গাড়ি ব্যাবহার করা
একজন মানুষ যত কম কায়িকশ্রম করে তার ক্যালোরি ততই কম পোড়ে। এছাড়াও, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ একজন ব্যক্তির হরমোন কিভাবে কাজ করে তা প্রভাবিত করে এবং শরীর কীভাবে খাদ্য প্রক্রিয়া করে তার উপরে হরমোনের প্রভাব রয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ইনসুলিনের মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করতে পারে এবং অস্থির ইনসুলিনের মাত্রা ওজন বাড়াতে পারে।
শারীরিক ক্রিয়াকলাপ শুধু জিমে প্রশিক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শারীরিক কাজ, হাঁটা বা সাইকেল চালানো, সিঁড়ি বেয়ে উঠা এবং গৃহস্থালির কাজ ইত্যাদি সবই অবদান রাখে।
তবে, শরীরচর্চার ধরন এবং তীব্রতা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে শরীরকে উপকৃত করার মাত্রাকে প্রভাবিত করে।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া: কিছু গবেষণা থেকে জানা যায় যে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া ওজন বৃদ্ধি ও স্থুলত্বের ঝুঁকি বাড়ায়। কারন এতে হরমোনের পরিবর্তন হতে পারে যা ক্ষুধা বাড়ায়। যখন একজন ব্যক্তির ঘুম পরিমিতভাবে সম্পন্ন না হয় তখন তাদের শরীরে গ্রেলিন নামক হরমোন তৈরি করে, যা ক্ষুধাকে উদ্দীপিত করে। একই সাথে ঘুমের অভাবে লেপটিন হরমোন কম উৎপাদিত হয়, যা ক্ষুধা দমন করে।
৪. অন্তঃস্রাবী ব্যাঘাত: ২০১২ সালের একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, পানীয়গুলিতে তরল ফ্রুক্টোজ (এক ধরনের চিনি) কীভাবে লিপিড এবং গ্লুকোজ বিপাকে পরিবর্তন আনতে পারে এবং বিপাকীয় সিন্ড্রোমের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
বিপাকীয় সিন্ড্রোম/মেটাবলিক সিন্ড্রোমের মধ্যে রয়েছে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ এবং উচ্চ রক্তচাপ। স্থুলতা আক্রান্ত ব্যক্তির মেটাবলিক সিন্ড্রোমের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
তাই উচ্চ ফ্রুক্টোজ যুক্ত কর্ন সিরাপ ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে।
৫. ওষুধ এবং ওজন বৃদ্ধি: কিছু ওষুধ গ্রহণের ফলেও ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। একটি ২০১৫ পর্যালোচনা এবং মেটা-বিশ্লেষণের ফলাফলে দেখা গেছে যে, কিছু ওষুধের কারণে মানুষের ওজন কয়েক মাসের ব্যবধানে বৃদ্ধি পায়। যেমন:
- অ্যাটিপিকাল অ্যান্টিসাইকোটিকস, বিশেষ করে ওলানজাপাইন, কুইটিয়াপাইন এবং রিস্পেরিডোন
- অ্যান্টিকনভালসেন্ট এবং মুড স্টেবিলাইজার, বিশেষ করে গ্যাবাপেন্টিন
- হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ওষুধ, যেমন টলবুটামাইড
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের জন্য গ্লুকোকোর্টিকয়েডস
- কিছু এন্টিডিপ্রেসেন্টস
আবার, কিছু ওষুধ ওজন হ্রাস করতে পারে। তাই কেও যদি নতুন ওষুধ শুরু করতে যান এবং তার ওজন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন তাহলে তা ডাক্তারের সাথে আগে থেকেই পরামর্শ করে নেওয়া উচিত যে ওষুধটি তাদের ওজনের উপর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না।
৬. স্থুলতা জিন: ফ্যাট ভর ও স্থুলতা সম্পর্কিত জিন (FTO) নামক একটি ত্রুটিপূর্ণ জিন স্থুলতার ক্ষেত্রে দায়ী। একটি ২০১৩ এর গবেষণা এই জিনের সাথে স্থুলতা, আচরণ যা স্থুলতার দিকে পরিচালিত করে, উচ্চমাত্রার খাদ্য গ্রহণ এবং উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবারের প্রতি আকর্ষণ নির্দেশ করে।
গ্রেলিন হরমোন খাওয়ার আচরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও শরীর বৃদ্ধির হরমোন নিঃসরন এবং অন্যান্য অংশে যে চর্বি জমা হয় তাও গ্রেলিন হরমোন প্রভাবিত করে।
FTO জিনের কার্যকলাপ একজন ব্যক্তির স্থুলত্বের ঝুঁকিকে প্রভাবিত করতে পারে তার কারণ এটি তাদের গ্রেলিনের পরিমাণকে প্রভাবিত করে।
স্থুলতার প্রতিরোধ ও প্রতিকার:
স্থুলতা চিকিৎসার সর্বোত্তম উপায় হলো স্বাস্থকর জীবনযাপন করা, কম ক্যালোরি যুক্ত সুষম খাদ্য গ্রহণ করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা। তার জন্য আপনার প্রয়োজন:
- খাদ্য বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরামর্শকৃত সুষম ও কম ক্যালোরি যুক্ত খাবার গ্রহন করা
- স্থানীয় ওজন কমানোর গ্রুপে যোগদান করা
- নিয়মিত শরীরচর্চা যেমন: হাঁটা, সাঁতার, দৌড়ানো ইত্যাদি চর্চা করা
- ধীরে ধীরে খাওয়া এবং এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা যেখানে অতিরিক্ত খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
- ঘুমের সময়সূচি ঠিক রাখা
- বিশেষ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের কাছ থেকে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা নেওয়া
সারসংক্ষেপ:
স্থুলতার বিকাশে অনেক কারণ ভূমিকা পালন করে। জেনেটিক বৈশিষ্ট্য কিছু লোকের মধ্যে ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া যাতে প্রচুর তাজা খাবার থাকে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা বেশিরভাগ মানুষের স্থুলতার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
কিন্তু, যাদের এই অবস্থার জিনগত প্রবণতা রয়েছে তাদের উপযুক্ত ওজন বজায় রাখা কঠিন হতে পারে।
২০২০ সাল থেকে ৪ ঠা মার্চ বিশ্ব স্থুলতা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বাস্তব-বিশ্বের পরিস্থিতিতে প্রয়োগিত সমাধান প্রচারের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক স্থূলতা সংকট মোকাবেলা এবং এইভাবে অতিরিক্ত ওজন এবং এর ফলে যে জটিলতাগুলি সৃষ্টি হয় তার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে।
Keywords: বাড়তি ওজন, স্থুলতা, ক্ষতিকর, স্বাস্থ্য, চর্বি, সচেতনতা, শরীরচর্চা, ফ্রুক্টজ, ক্যলরি, BMI, শারীরিক গঠন, অলস, জীবনযাত্রা