পরিবেশগত স্বাস্থ্য সমস্যার বিশ্লেষণ নিচে বর্ণনা করা হলোঃ
আমরা বরাবরই জানি যে আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে গড়ে ওঠে পরিবেশ। গাছ-পালা, পশু-পাখি, খাল-বিল, নদী-নালা, আকাশ, মাটি, বাতাস সবই এই পরিবেশের অংশ। কিন্তু এই চারপাশের পরিবেশ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর তা আমাদের স্বাস্থ্যের উপরে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে আমাদের ধারনা অনেক সামান্য। এইখানেই চলে আসে পরিবেশগত স্বাস্থ্যের কথা।
পরিবেশগত স্বাস্থ্য জনস্বাস্থ্যের একটি শাখা যা মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক নিরীক্ষণ করে, আর প্রাকৃতিক এবং মানব-সৃষ্ট কারণসমূহ পরিবেশের সাথে মানুষের সুস্থতার উপর কি প্রভাব ফেলে তা পরীক্ষা করে।
পরিবেশগত স্বাস্থ্যের ভূমিকা ও গুরুত্ব
পরিবেশগত স্বাস্থ্য গবেষণার ভূমিকা হল পরিবেশের এমন ক্ষেত্রগুলি পরীক্ষা করা যা আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, যাতে আমরা নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখতে পারি। একইসাথে মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য যেনো ব্যক্তিগত এবং নীতিগত পরিবর্তন করতে পারি।
পরিবেশগত স্বাস্থ্য আমাদের প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব ফেলে। এমনকি গাছ-পালা, পশু-পাখির স্বাস্থ্যের উপরেও। আমরা বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যকর মাটির সুবিধা ভোগ করি। যদি আমাদের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আমাদের সম্পদকে পরিপূর্ণ করে এবং প্রচুর দূষণ থাকে, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশগত স্বাস্থ্য আমাদের অধ্যয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র কারণ এটি আপনার স্বাস্থ্যের উপর “অদেখা” প্রভাবগুলি ফেলে। অনেক ব্যক্তি তাদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সাথে যে বায়ু বা জলের গুণমান, বা তারা কোন পোশাক পরেন, মেকআপ এবং গৃহস্থালীর জিনিসপত্র ব্যবহার করেন বা খাবার খান এইগুলা জড়িত তা বুঝতে পারেন না। এর কারণ হল পরিবেশগত স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিটি উদাহরণ স্পষ্ট নয়: কিছু রাসায়নিক যা আপনার শরীরে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে তৈরি হয় তার একটি ছোট ডোজ ক্ষতি আনতে পারে বলে মনে হয় না, তবে বারবার ছোট ডোজ পরবর্তী প্রভাবের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও, পৃথক সংবেদনশীলতা কাজ করতে পারে: উদাহরণস্বরূপ, একটি পরিবারের একজন সদস্য তাদের জল সরবরাহে পাওয়া রাসায়নিক থেকে অসুস্থতা, হাঁপানি, মাইগ্রেন ইত্যাদি অনুভব করতে পারে অপরদিকে একই পরিবারের অন্য সদস্য ঠিক সুস্থ থাকতে পারে। প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ, গর্ভাবস্থা এবং অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের অবস্থা ভূমিকা পালন করে। আমাদের পরিবেশ থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক এবং অন্যান্য প্রভাবের সাথে আমাদের মিশে থাকার হার, সময়কাল এবং ফ্রিকোয়েন্সি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী। সুতরাং ভাল পরিবেশগত স্বাস্থ্য = ভাল মানব স্বাস্থ্য।
প্রধান পরিবেশগত স্বাস্থ্য সমস্যাসমূহ
সব ধরনের দূষণ এবং পরিবেশগত সমস্যা একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং একে অপরের সাথে জড়িত, তাই সবাইকে একসাথে মোকাবেলা করতে হবে। প্রধান পরিবেশগত সমস্যাগুলো হলোঃ
- জলবায়ু পরিবর্তনঃ গ্রিনহাউস গ্যাস দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট হয় যা সূর্য থেকে তাপ আটকে রাখে এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠকে উষ্ণ করে; সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা সামুদ্রিক বাসস্থান এবং বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে; বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করে যা ভূমি সঙ্কুচিত হওয়া, ব্যাপক বন্যা এবং বিশ্বজুড়ে বিচিত্র আবহাওয়ার ঘটনার জন্য দায়ী।
- দূষণঃ জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত পরিবেশগত সমস্যার জন্য দূষণ একটি প্রাথমিক কারণ। সব ধরনের পানি, বায়ু, মাটি, শব্দ, আলো এবং তাপ দূষণ পরিবেশকে প্রভাবিত করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বায়ু, মাটি এবং পানির গুণমানকে দূষিত ও অবনমিত করা জনস্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পানি এবং বায়ু দূষণ একটি বিশাল উদ্বেগের কারণ যা মানব ও সামুদ্রিক জীবনের জন্য আর্থিক চাপ এবং বিপদ সৃষ্টি করে। দূষণের কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
- বন নিধনঃ বন উজাড়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত গাছপালা এবং গাছগুলি ধ্বংস করা যা জনসাধারণকে অক্সিজেন, খাদ্য, জল এবং ওষুধ সরবরাহ করে। প্রাকৃতিক দাবানল, অবৈধ লগিং, কৃষি কাজ এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে কাঠ আহরণের ফলে বন হ্রাস, অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য মূলত বাস্তুতন্ত্রের সবচেয়ে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে অন্তর্ভুক্ত করে যা বিশ্ব উষ্ণায়ন, দূষণ এবং বন উজাড়ের সাথেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।
- রোগঃ রোগ প্রশমন এবং নিয়ন্ত্রণ পরিবেশগত স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। পরিবেশ দূষণের সাথে পানিবাহিত, বায়ুবাহিত রোগের সংযোগ রয়েছে যা নিয়ন্ত্রনে না আনলে ক্ষতিকর প্রভাবকসমূহ যা স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তা পরিবেশের অবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে।
- বিপজ্জনক বর্জ্যঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিপজ্জনক উপাদান ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, দূষিত স্থান প্রতিকার, ভূগর্ভস্থ স্টোরেজ ট্যাঙ্কের ক্ষয় প্রতিরোধ, জরুরী প্রতিক্রিয়া এবং পরিবেশে বিপজ্জনক পদার্থের নিঃসরণ প্রতিরোধ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রাকৃতিক সম্পদের দূষণ বা অসুস্থতা ছড়ানোর সম্ভাবনা রোধ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানকে পরিবর্তন করছে যার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি এবং বর্জ্য পরিচালনার প্রয়োজন। কারণ শিল্পের অগ্রগতির সাথে সম্পর্কিত কৌশল এবং উপকরণগুলি প্রায়শই সংক্রামক রোগের সাথে যুক্ত থাকে।
পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নয়নের উপায়
পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবার প্রথমে আমাদের নিজেদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। অনেকেই পরিবেশগত স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে অবগত নয়। তাই সবার প্রথমে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহন প্রয়োজন। আপনার নিজের ব্যক্তিগত পরিবেশের খোঁজ নেওয়ার মাধ্যমে শুরু করুন। আপনার এলাকায় বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণ দেখু, রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি দেখতে আপনার পানি পরীক্ষা করুন। আপনি আপনার জীবনে যে পণ্যগুলি ব্যবহার করেন তা মূল্যায়ন করুন — ব্যক্তিগত পণ্য যেমন শ্যাম্পু এবং ডিওডোরেন্ট, গৃহস্থালী পরিষ্কারক, এয়ার ফ্রেশনার, আপনি যে খাবারগুলি খাচ্ছেন — এবং দেখুন আপনি আপনার বাড়িতে কী আনছেন৷এইভাবে ছোট ছোট পদের মাধ্যমেই বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
পরিবেশ দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি ও কিভাবে তা রোধ কতা যায় তা নিয়ে পরবর্তিতে আরও বিষদ আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। উপরোক্ত লেখার মূল উদ্দেশ্য পরিবেশগত স্বাস্থ্যের বিষয়ে আলোকপাত করা এবং এর পেছনের কারন সম্বন্ধে অবগত করা।
Keywords: পরিবেশগত স্বাস্থ্য, পরিবেশ দূষণ, ক্ষতি, রোগ, বায়ু, পানি, রাসায়নিক বর্জ্য, ব্যবস্থাপনা, বন নিধন, সচেতনতা, প্রভাব, জনস্বাস্থ্য