‘অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা’ বা ‘স্বল্পাহারজনিত কৃশতা’ একটি রোগ যা খাদ্যাভ্যাসের অস্বাভাবিক প্রবণতার কারণে ঘটে। এই রোগের আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। যদিও যেকোনো বয়সে এই রোগ হতে পারে, তবে সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ-
বয়স ও উচ্চতার ভিত্তিতে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম স্বাভাবিক ওজন থাকা উচিত, কিন্তু অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসায় আক্রান্ত রোগীর ওজন সাধারণত এ পরিমাণের চেয়ে অনেক কম থাকে। রোগীরা স্বেচ্ছায় ওজন কমানোর চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন অজুহাতে খাবার এড়িয়ে চলে।
অতিরিক্ত ব্যায়াম করার পাশাপাশি, কিছু মানুষ এমন সব ওষুধ ব্যবহার করে যা শরীর থেকে খাবার ও পানি বের করে দেয় অথবা খাবারের প্রতি অরুচি সৃষ্টি করে। রোগীর নিজের দেহের আকৃতি ও ওজন সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকে এবং তারা অতিরিক্ত কৃশ হয়ে যাওয়ার পরও নিজেদের স্থূল মনে করে।
রোগী সব সময় ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে ভোগে এবং আরও ওজন কমানোর জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে। তারা মনে করে, খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে জীবন অকার্যকর হয়ে যাবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে জীবনের সার্থকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। ওজন কমে যাওয়ার কারণে যে গুরুতর শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, তা রোগী স্বীকার করতে চায় না।
ক্ষতিকর প্রভাব –
রোগীদের অনাহারের ফলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। শরীরের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিকের ভারসাম্য ভেঙে যায়, এবং পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফেটসহ অন্যান্য ইলেকট্রোলাইটের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে। হরমোনের অসঙ্গতি দেখা দেয়, ফলে দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথাব্যথা, খাদ্যনালির সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকের শুষ্কতা এবং খিঁচুনির মতো উপসর্গ প্রকাশ পায়। নাড়ির গতি ও রক্তচাপ কমে যায়, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নতুন লোম গজায়। গোড়ালি ও চোখের চারপাশে পানি জমে ফুলে যায়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি কমে যাওয়ার ফলে হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায় এবং অস্টিওপোরোসিস নামক হাড় ক্ষয়ের রোগ হতে পারে। এ ছাড়া রক্তশূন্যতা দেখা দেয়, রোগী ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এই অবস্থার চলমান থাকলে রোগীর কিডনি অকেজো হতে পারে এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে হরমোনের অস্বাভাবিকতার কারণে মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বয়ঃসন্ধির আগে বা শুরুতে যদি এই রোগ হয়, তবে রোগীর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এছাড়া, রোগীরা বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যায় ভোগে, এবং কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এই রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে।
কারণ –
গবেষকরা এ রোগের জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেছেন। বংশগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এই রোগে। মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক উপাদান বা নিউরোট্রান্সমিটারের অস্বাভাবিকতার কারণে এই রোগের সৃষ্টি হতে পারে। যেখানে অতিরিক্ত ‘স্লিম’ বা অস্বাভাবিক চিকন মেয়েদের সৌন্দর্যের আদর্শ হিসেবে দেখা হয়, সেখানকার ঝুঁকি বেশি। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া, মা-বাবার বিচ্ছেদ এবং কিছু ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, যেমন আত্মবিশ্বাসের অভাব ও ‘পারফেকশনিজম’।
চিকিৎসা –
যাদের শারীরিক অবস্থা গুরুতর, যেমন বিপজ্জনকভাবে কম ওজন বা দ্রুত ওজন হ্রাস, অথবা যাদের মারাত্মক বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসার প্রথম ধাপ হল রোগীকে সঠিক ওজন ফিরে পাওয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া, যা খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর মাধ্যমে করা হয়। যদি মুখে খাওয়ানো সম্ভব না হয়, তবে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া হয়। অনাহারের কারণে কোনো শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হলে তার চিকিৎসা করা হয়। শরীরে ইলেকট্রোলাইট ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করার পর ধাপে ধাপে রোগীর ওজন বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। রোগীর খাদ্যগ্রহণের দায়িত্ব কোন সেবিকা বা তত্ত্বাবধায়ক নিতে পারলে তা বেশি কার্যকর। ওজন বাড়ানোর লক্ষ্য ঠিক করার আগে রোগীকে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা ব্যাখ্যা করে তাদের আস্থা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সাইকোথেরাপির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগী ও তার পরিবারকে রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে সচেতন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ওষুধও প্রয়োজন হতে পারে। Healthx BD
আরও জানুন-