লুপাস একটি অটোইমিউন রোগ যা এমন একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজের সুস্থ কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে।
লুপাস কী
লুপাস একটি মাল্টি সিস্টেম ডিজিজ, যা শরীরের কোষ ও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে। ত্বক, চোখ, মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ এমন কিছু নেই, যা লুপাসে আক্রান্ত হয় না।
লুপাস কেন হয়
অটোইমিউন অন্যান্য রোগের মতো, লুপাসের কারণ এখনও পুরোপুরি নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে দেখা গেছে, লুপাস নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীরা লুপাসের ঝুঁকিতে ৯ গুণ বেশি।লুপাস হতে পারে জেনেটিক বা বংশগত কারণে, পাশাপাশি পরিবেশগত কারণ, বায়ু দূষণ, ধূমপান, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার, হরমোনের প্রভাব, এবং কিছু নির্দিষ্ট ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন নিজের কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে, তখন প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং এই অবস্থার কারণে লুপাসের মতো অটোইমিউন ডিজিজ দেখা দেয়।
লুপাসের লক্ষণ
লুপাস রোগের পূর্ণ নাম হলো সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথ্রোমেটোসিস (এসএলই)। ‘লুপাস’ ল্যাটিন ভাষায় মানে ‘নেকড়ে’, এবং যেমন নেকড়ে ধীরে ধীরে শিকারকে আক্রমণ করে, তেমনি লুপাসও ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
লুপাসের লক্ষণ অন্যান্য রোগের মতই সাধারণ হতে পারে, তবে এসব লক্ষণ দীর্ঘসময় ধরে থাকতে পারে। হঠাৎ করেই রোগীর কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হতে পারে, যা বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে দেখা যেতে পারে জ্বর, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, এবং লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া। পরবর্তীতে জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হতে পারে, যদিও ব্যথা সাধারণত তীব্র হয় না। ত্বকে কিছু লক্ষণ যেমন রোদে গেলে ত্বক জ্বালা-পোড়া, লাল র্যাশ বা ফুঁসকুড়ি, ঠান্ডা পানিতে হাত দিলে হাতের রঙ পরিবর্তন হওয়া, চুল পড়া, এবং মুখে ঘা হতে পারে। এগুলো মৃদু লুপাসের লক্ষণ এবং সাধারণত বেশি দেখা যায়।
অতিরিক্ত কিছু লক্ষণ যেমন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে দেওয়া, কিডনির ছাকনিতে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়া, শরীর থেকে প্রোটিন বের হওয়া, প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া, কিডনি বিকল হওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ফুসফুসে পানি জমা বা শুকিয়ে যাওয়া, লিভারে সমস্যা, এবং মস্তিষ্কে খিঁচুনি বা স্ট্রোকের লক্ষণও দেখা যেতে পারে। এসব জটিল লক্ষণ লুপাস রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
লুপাসে গর্ভধারণে জটিলতা
লুপাস রোগে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন এবং এ রোগের কারণে তাদের গর্ভধারণ ও যৌন স্বাস্থ্যের জটিলতা দেখা দেয়। নারীরা লুপাসের কারণে বারবার গর্ভপাত করতে পারেন এবং গর্ভধারণে সমস্যা অনুভব করতে পারেন। গর্ভাবস্থায় লুপাসের তীব্রতা কখনও বেড়ে যেতে পারে, আবার কখনও অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
এক বিশেষ ধরনের লুপাস রয়েছে যার নাম অ্যান্টিফসফোলিপিড সিন্ড্রোম। এই অবস্থায়, উপরের লক্ষণগুলির পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু লক্ষণও দেখা দিতে পারে বা একসাথে থাকতে পারে।এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীরা গর্ভধারণের পর ১০ সপ্তাহের মধ্যে বারবার গর্ভপাতের সম্মুখীন হতে পারেন। এছাড়া, গর্ভজাত সন্তানের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে, নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তান প্রসব হতে পারে, বা পানি ভেঙে যাওয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, গর্ভের সন্তান মারা যেতে পারে।যদি রোগের তীব্রতা বেশি হয়, তাহলে গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এছাড়া, লুপাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গর্ভধারণ ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে এবং অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যাও হতে পারে।কিডনি বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আক্রান্ত থাকলে, দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ সেবন, মানসিক চাপ, হতাশা, এবং উদ্বেগও গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
চিকিৎসা
চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে প্রথমে রোগ সম্পর্কে কাউন্সিলিং করা হয়। রোগের তীব্রতা—মৃদু, মাঝারি, নাকি অতি তীব্র—এর ওপর ভিত্তি করে রোগীকে নির্দিষ্ট ওষুধ, ডোজ, এবং চিকিৎসার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। লুপাস একটি অটোইমিউন রোগ হওয়ায়, ইমিউনোসপ্রেসিভ মেডিকেশনও রোগীকে প্রদান করা হয়।
নারীদের ক্ষেত্রে ফার্টিলিটি কাউন্সিলিং করা হয়। এতে বলা হয় কখন তারা গর্ভধারণ করতে পারবেন এবং কীভাবে গর্ভধারণ করবেন, তাই সন্তান নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লুপাসের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রোগের তীব্রতা ও জটিলতা নিয়ন্ত্রণে এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি রোধ করতে কিছু ওষুধ সারাজীবন সেবন করতে হতে পারে।
প্রয়োজনীয় সচেতনতা
লুপাস রোগের চিকিৎসায় সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রোগী প্রথমে রোগের গুরুত্ব বুঝতে পারেন না, ওষুধ কিছুদিন ব্যবহার করার পর তা ছেড়ে দেন, এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে যান না। একই ওষুধ দীর্ঘসময় খাওয়ার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, কিন্তু রোগীরা ফলোআপে যেতে চান না। এ ক্ষেত্রে রোগীর সচেতনতা থাকা অত্যাবশ্যক। তাই লুপাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা, নির্ধারিত সময়ে চিকিৎসা নেওয়া, এবং নিয়মিত ফলোআপ করা জরুরি।
যদি সচেতন না থাকেন, রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে এবং হঠাৎ করে কিডনি, ফুসফুস, বা মস্তিষ্কসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে, লুপাস মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে এবং শরীরের কোনো অঙ্গ পুরোপুরি বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর মধ্যে রয়েছে খিঁচুনি, হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, অপটিক নার্ভের শুকিয়ে যাওয়া, কিডনির ছাকনিতে প্রদাহ, এবং ফুসফুসে রক্তক্ষরণ যা শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
তাই লুপাসের লক্ষণ সম্পর্কে জানা এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তা সনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Healthx BD
–শুষ্ক চোখ বা ড্রাই আই এর সমস্যার কারণ ও প্রতিকার