ডেঙ্গুজ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা আক্রান্ত মশার মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। বাংলাদেশের মত গ্রীস্মমন্ডলীয় (এশিয়া-প্যাসিফিক) অঞ্চলে এই রোগ বেশি দেখা যায় । সাধারণত শহর এবং জেলা শহরের মানুষ এতে বেশি আক্রান্ত হয়।
এডিস মশার দুইটি ধরনের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় তবে এডিস এ্যালবোপিকটাস মশার চেয়ে এডিস এজেপ্টি মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গু বেশি ছড়ায়।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন আছে যেমন: ডেঙ্গু ভাইরাস-১, ২,৩, এবং ৪। এই চারটি ধরণের যেকোন একটির মাধমে মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। এরমধ্যে কোন ধরণের ডেঙ্গু ভাইরাস বেশি ছড়াচ্ছে তা এখনো অজানা তবে ২০১৯ সাল থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস-৩ এর কিছু সংক্রমন সনাক্ত হয়েছে তবে গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু ভাইরাস-৪ এর সংক্রমন দেখা যাচ্ছে না (তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক ধারক মানুষ অর্থাৎ মানুষ এই ভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত হয় এরপর স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ানোর মাধ্যমে এই রোগের বাহক হয়। তারপর এই ভাইরাস ৮-১০ দিন পর মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন লালাগ্রন্থিতে এসে জমা হয় তখন এই মশার কামড়ের মাধ্যমে অন্য মানুষ আবার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় তাই এটি ছোয়াচে রোগ নয় শুধুমাত্র মশার মাধ্যমে একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো স্ত্রী প্রজাতির এডিস মশা একবার ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলে মশাটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ভাইরাস ছড়াতে থাকে। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু যেমন: অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত,জলাবদ্ধতা,বন্যা,তাপমাত্রা বৃদ্ধি,দেশের ঋতু পরিবর্তনের জন্য মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন ডেঙ্গু,চিকনগুনিয়া,ম্যালেরিয়ার জন্য আদর্শ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ সনাক্ত করা হয় তখন এটি ”ঢাকা ফিভার” নামে পরিচিত ছিল। এডিস এজেপ্টি মশার আবাসস্থল বৃদ্ধি বা জমে থাকা পানি দ্রুত নিষ্কাশন না হওয়া এবং দ্রæত নগরায়ন ডেঙ্গুকে বাংলাদেশের এনডেমিক বা আঞ্চলিক রোগ হিসেবে পরিচিত করেছে। তবে বিশ্বের অর্ধেক মানুষই এখন ডেঙ্গু সংক্রমনের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং প্রতি বছর সারা বিশ্বে ১০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।
বেশিরভাগ ডেঙ্গু সংক্রমনে কিছু সাধারন উপসর্গ থাকে এবং রোগী হালকা অসুস্থতা বোধ করে । তবে ৮০% এর বেশি ক্ষেত্রে এটি লক্ষণবিহীন এবং সাধারন ডেঙ্গু জ্বর অল্প দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। হাড় ও মাংসপেশীতে এবং জয়েন্টে ব্যথার কারণে একে ব্রেক বোন ডিজিজ ও বলা হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরণের হয়ে থাকে
১.সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর
২.সিভিয়ার বা হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর
১.সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর:
সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণ ফ্লু বা সর্দি জ্বরের মত লক্ষণ দেখা যায় এবং তা ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়।এর উপসর্গগুলো হলো
জ্বর (১০২ থেকে সর্বোচ্চ ১০৪ ডিগ্রী)
মাথাব্যাথা ও চোখের পেছনে ব্যাথা
ক্লান্তি বা দূর্বল বোধ করা
শরীরে শীতলতা অনুভব করা
খাবারের রুচি কমে যাওয়া এবং বমি
গলা (গ্ল্যান্ড) ফুলে যাওয়া
হাড় ও মাংসপেশীতে ব্যাথা
শরীরে এলার্জি বা ঘামাচির মতো র্যাশ বের হওয়া
২.সিভিয়ার বা হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর :
ডেঙ্গু রোগীর এই অবস্থাটি সবচেয়ে জটিল ।এ সময় সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষনের পাশাপাশি আরো কিছু জটিলতা দেখা যায় যেমন:
জ্বর (১০২ থেকে সর্বোচ্চ ১০৫ ডিগ্রী পর্যন্তও হতে পারে)
প্রচন্ড পেটে ব্যথা (পাকস্থলী এবং তলপেট)
ক্রমাগত বমি হওয়া
শ্বাসকষ্ট
প্রচন্ড দূর্বলতা
প্রস্রাব কমে যাওয়া
মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
সিভিয়ার বা হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরের ফলে শরীরে যা যা হতে পারে
প্লাজমা লিকেজ হয়ে ফুসফুসে পানি এসে শ্বাসকষ্ট হতে পারে,পেটে পানি আসতে পারে,লিভার আক্রান্ত হতে পারে,কিডনী বিকল বা রেনাল ফেইলিওর হতে পারে।
প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে (বমি,পায়খানা,মাড়ি,নাক, থেকে)
শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যেতে পারে
হাত পা সহ শরীরের অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে
হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে
রক্তের প্লাটিলেট আশংকাজনকভাবে কমতে শুরু করতে পারে
ডেঙ্গু রোগের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন নেই তবে সময়মতো
ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস নির্ণয়
সিভিয়ার বা মারাত্বক ডেঙ্গু রোগের চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা এবং অবহেলা না করে সময়মতো ডাক্তার বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া
সঠিক ভাবে কেস ম্যানেজমেন্ট বা চিকিৎসা এবং সেবা প্রদান ই ডেঙ্গু রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
জ্বর হলে করণীয়:
তাই এই ডেঙ্গুর সময়টাতে জ্বর হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস টেষ্ট করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে
পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং তরল জাতীয় খাবার যেমন কর্ণ সুপ,ভাতের মাড় , নরম ও পাতলা খিচুড়ী( সবজিসহ বা সবজি ছাড়া),,ডাবের পানি,স্যালাইন, গ্লুকোজ,ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলের রস এবং কম মসলাযুক্ত স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে
জ্বও ও ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ধরণের আ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না
ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব মূলত এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে সারাবছরই ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে ।২০২৩ সালে শুরু থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ শুরু হয়েছে এবং প্রায় সারাদেশের মানুষই এতে আক্রান্ত হচ্ছে।এ বছর জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৩,৮৫৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ২০৪ জন (সূত্র:ডি জি এইচ এস) ।
ডেঙ্গু রোগে আতংকিত না হয়ে সচেতন হতে হবে রোগের কারন ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে হবে।পাশাপাশি ডেঙ্গু মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে।দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় মশারী টানাতে হবে।
ডেঙ্গুর সময়টাতে জ্বর হলে অবশ্যই আগে টেষ্ট করে নিশ্চিত হতে হবে তা ডেঙ্গু জ্বর কি না এবং ডেঙ্গু যেহেতু একটি ভাইরাসজনিত রোগ তাই যেকোন ওষু্ধ গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে কারণ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ তা ডেঙ্গু জ্বরের জটিলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে । রোগীর শরীরে গুরুতর লক্ষণ বা উপসর্গ গুলির কোন একটি দেখা দিলে অবশ্যই অতি দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগী কে নিকটবর্তী হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার।যেকোন ধরণের জটিলতা এড়াতে অনলাইন বা অফলাইনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন ।