মস্তিষ্ক মানবদেহের সবচেয়ে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি আমাদের চিন্তা, স্মৃতি, অনুভূতি, এবং শারীরিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। একটি সুস্থ এবং সচল মস্তিষ্ক আমাদের জীবনের মান উন্নত করে। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু বদঅভ্যাস নীরবে মস্তিষ্কের ক্ষতি করে চলেছে। এই অভ্যাসগুলো সম্পর্কে সচেতনতা আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে।
১. অপর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের ক্ষতির প্রধান কারণ:
ঘুম আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, বিশেষ করে মস্তিষ্কের জন্য। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক নিজেকে পুনরুদ্ধার করে এবং দিনের বেলায় অর্জিত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।

১.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া: ঘুম কম হলে নতুন তথ্য মনে রাখা এবং পুরনো তথ্য মনে করতে অসুবিধা হয়।
মনোযোগের অভাব: মনোযোগ কমে যাওয়া এবং কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া।
সিদ্ধান্তহীনতা: সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হওয়া।
দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি: দীর্ঘকাল ধরে ঘুমের অভাব ডিমেনশিয়া এবং আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
১.২ করণীয়:
- প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
- একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন।
- ঘুমানোর আগে ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল পরিহার করুন।
- ঘুমানোর আগে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
২. অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম:
বর্তমান যুগে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম মস্তিষ্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
দৃষ্টি সমস্যা: দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের ক্লান্তি, শুষ্কতা এবং দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
ঘুমের ব্যাঘাত: স্ক্রিনের নীল আলো ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের উৎপাদনে বাধা দেয়, যার ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়।
মনোযোগের অভাব: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং মাল্টিটাস্কিং এর প্রবণতা বাড়ায়, যা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াতে পারে।
২.২ করণীয়:
- স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন।
- প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিন ব্যবহারের পর ২০ সেকেন্ডের জন্য দূরে তাকান।
- ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন ব্যবহার বন্ধ করুন।
- শারীরিক কার্যকলাপ এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য সময় বের করুন।
৩. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
আমাদের খাদ্যাভ্যাস মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অতিরিক্ত চিনি, চর্বি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর।
৩.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: অতিরিক্ত চিনি এবং চর্বিযুক্ত খাবার মস্তিষ্কের স্মৃতি এবং শেখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
মনোযোগের অভাব: অস্বাস্থ্যকর খাবার মনোযোগ এবং একাগ্রতা কমিয়ে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: অস্বাস্থ্যকর খাবার বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
মস্তিষ্কের প্রদাহ: প্রক্রিয়াজাত খাবার মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৩.২ করণীয়:
- ফল, সবজি, শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ সুষম খাবার গ্রহণ করুন।
- অতিরিক্ত চিনি, চর্বি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।

৪. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা:
শারীরিক কার্যকলাপ শুধু শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে।
৪.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়।
মনোযোগের অভাব: ব্যায়ামের অভাবে মনোযোগ এবং একাগ্রতা কমে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের ঝুঁকি বাড়ায়।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস: ব্যায়ামের অভাবে মস্তিষ্কের সামগ্রিক কার্যকারিতা কমে যায়।
৪.২ করণীয়:
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য মাঝারি ধরণের ব্যায়াম করুন।
- হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার, যোগা বা অন্য কোনো শারীরিক কার্যকলাপ করুন যা আপনার পছন্দ।
- প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য শারীরিক কার্যকলাপের জন্য সময় বের করুন।
৫. ধূমপান এবং অ্যালকোহল:
ধূমপান এবং অ্যালকোহল উভয়ই মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ধূমপান:
- মস্তিষ্কের রক্তনালী সংকুচিত করে, যার ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যায়।
- স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মনোযোগের অভাব এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
- স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
অ্যালকোহল:
- মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট করে।
- স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং সমন্বয় কমিয়ে দেয়।
- দীর্ঘমেয়াদী অ্যালকোহল সেবন মস্তিষ্কের আকার কমাতে পারে।
করণীয়:
ধূমপান এবং অ্যালকোহল পরিহার করুন।

৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা:
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা মানসিক এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
৬.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ: সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের ঝুঁকি বাড়ায়।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: সামাজিক বিচ্ছিন্নতা স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে।
ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি: সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
৬.২ করণীয়:
- পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটান।
- সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন।
- নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হন।
৭. উচ্চ শব্দে গান শোনা:
অতিরিক্ত শব্দ মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে হেডফোনে উচ্চ শব্দে গান শোনা শ্রবণশক্তি এবং মস্তিষ্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৭.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
শ্রবণশক্তি হ্রাস: উচ্চ শব্দে গান শুনলে শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে।
মনোযোগের অভাব: উচ্চ শব্দ মনোযোগ কমিয়ে দেয়।
মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি: উচ্চ শব্দ মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি করতে পারে।
৭.২ করণীয়:
- কম ভলিউমে গান শুনুন।
- হেডফোন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন।
৮. মাল্টিটাস্কিং:
একসাথে একাধিক কাজ করার চেষ্টা করাকে মাল্টিটাস্কিং বলে। যদিও মনে হয় এটি সময় বাঁচায়, কিন্তু এটি মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর।
৮.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
মনোযোগের অভাব: মাল্টিটাস্কিং মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং কাজের মান খারাপ করে।
স্ট্রেস বৃদ্ধি: মাল্টিটাস্কিং স্ট্রেস এবং উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: মাল্টিটাস্কিং নতুন তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

৮.২ করণীয়:
- এক সময়ে একটি কাজের উপর মনোযোগ দিন।
- কাজের তালিকা তৈরি করুন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করুন।
৯. নেতিবাচক চিন্তা:
নেতিবাচক চিন্তা মস্তিষ্কের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত নেতিবাচক চিন্তা স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে।
৯.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
স্ট্রেস এবং উদ্বেগ: নেতিবাচক চিন্তা স্ট্রেস এবং উদ্বেগ বাড়ায়।
বিষণ্ণতা: ক্রমাগত নেতিবাচক চিন্তা বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: নেতিবাচক চিন্তা স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে।
৯.২ করণীয়:
- ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করুন।
- ধ্যান এবং যোগা করুন।
- মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
১০. নতুন কিছু না শেখা:
মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য নতুন কিছু শেখা প্রয়োজন। নতুন কিছু না শিখলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায়।
১০.১ ক্ষতিকর প্রভাব:
স্মৃতিশক্তি হ্রাস: নতুন কিছু না শিখলে স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
মনোযোগের অভাব: নতুন কিছু না শিখলে মনোযোগ এবং একাগ্রতা কমে যায়।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস: নতুন কিছু না শিখলে মস্তিষ্কের সামগ্রিক কার্যকারিতা কমে যায়।
১০.২ করণীয়:
- নতুন ভাষা শিখুন।
- বই পড়ুন।
- নতুন কোনো শখ তৈরি করুন।
- বিভিন্ন সেমিনার এবং ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করুন।
উপরে উল্লেখিত বদঅভ্যাসগুলি পরিহার করে এবং সুস্থ জীবনযাপন অনুশীলন করে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি। মনে রাখবেন, একটি সুস্থ মস্তিষ্ক একটি সুখী এবং কার্যক্ষম জীবনের মূল চাবিকাঠি।Healthx BD
আরও জানুন-